![আওয়ামী লীগে অবিলম্বে কঠোর শুদ্ধি অভিযান দরকার](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/10/gaffar_134523.jpg)
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ১০ এপ্রিল, এবিনিউজ : আমার শৈশবে ‘শিশু সাথী’ নামে এক শিশু-মাসিকে ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’ নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটির সারমর্ম ছিল ঘোগরা বাঘের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না পেরে তাদের দলে মিশে গিয়ে তাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। সম্প্রতি কালের কণ্ঠে ‘জামায়াত-শিবির থেকে আওয়ামী লীগে পদধারী’ শীর্ষক খবরটি পাঠ করে শঙ্কিত হয়েছি এবং শৈশবে পড়া গল্পটির কথা মনে পড়েছে।
খবরটিতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবির থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলে যোগ দেওয়া হচ্ছে, তাকে আর দলবদল বলা যায় না, বলা যায় অনুপ্রবেশ। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। আর এই অনুপ্রবেশ স্রোতের আকার ধারণ করে ২০১৪ সালে চারদলীয় জোটের সহিংস আন্দোলন দমে যাওয়ার পর থেকে। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির থেকে আওয়ামী লীগে আসা চলবে না। তার পরও অনুপ্রবেশ থেমে নেই। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের, বিশেষ করে জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে ঢুকে অনেকেই বড় বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছে।’
এই অনুপ্রবেশকারীরা কে কোথায় আওয়ামী লীগে উচ্চপদ দখল করেছে, তার একটা দীর্ঘ তালিকাও প্রকাশ করেছে কালের কণ্ঠ। একটি উদাহরণ, ‘২০১৬ সালে বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগে যোগ দেন ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারঘরিয়া জামায়াতের আমির মাওলানা আবুল খায়ের। একই বছর ১ অক্টোবর যোগ দেন জেলা জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা সোহরাব আলী। জামায়াতের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় নেতা আফরোজ জুলমত আলী, জামায়াত নেতা আবদুল্লা হেল বাকি ও মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তাঁরা সবাই একাধিক নাশকতা মামলার আসামি। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁদের মামলাগুলো ধামাচাপা পড়ে। খবরটিতে সারা দেশেই আওয়ামী লীগে জামায়াতিদের অনুপ্রবেশ এবং উচ্চপদ দখলের দীর্ঘ তালিকা দেওয়া হয়েছে। এর পুনরুল্লেখের দরকার নেই। তবে এই দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জামায়াতপন্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়েই আওয়ামী লীগে প্রবেশ করছে। কারণ তারা জঙ্গি হয়ে বাইরে থেকে কিছু করতে পারেনি। এখন ভেতরে ঢুকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়।’
প্রতিবেদনটি পড়ার আগে আওয়ামী লীগে জামায়াতের অনুপ্রবেশের খবরটি জানতাম, তা যে এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, জানতাম না। কয়েক বছর আগের কথা, এক মন্ত্রী এসেছেন লন্ডনে। হাইকমিশনে তাঁর সঙ্গে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার ঘরোয়া বৈঠকে আমিও হাজির ছিলাম। প্রয়াত মিজারুল কায়েস তখন হাইকমিশনার। মন্ত্রী মহোদয় গর্ব প্রকাশ করে সেই বৈঠকে বলেছিলেন, তিনি দিনাজপুরে প্রায় দুই হাজারের মতো জামায়াতিকে আওয়ামী লীগে এনেছেন। আমরা শঙ্কিত হয়ে বলেছি, এটা কি ভালো হলো? তিনি গলা উঁচিয়ে বলেছেন, ভালো হলো না কেন? এভাবে দেশের সব জামায়াতিকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসতে পারলে জামায়াতের অস্তিত্ব আর থাকবে না। আমি মৃদুস্বরে বলেছি, আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকবে কি? তিনি আমার প্রশ্ন না শোনার ভান করেছেন।
শত্রুকে নিপাত করার জন্য কী কৌশলে তাদের দলে ঢুকে উদ্দেশ্য সফল করা যায় তার প্রাচীনকালের উদাহরণ তো ট্রোজান হর্সের গল্প। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও শত্রুদলে অনুপ্রবেশ করে শত্রুকে শায়েস্তা করার বহু বিবরণ জানা যায়। ব্রিটিশ আমলের অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগাররা নির্বাচনে হেরে গিয়ে ফজলুল হকের দলে ঢুকে কিভাবে তাঁকে কিছুকালের জন্য নেতা মেনে পরে তাঁকে আছড়ে দূরে ফেলে দিয়েছিল, সে কাহিনি তো এখন এক ইতিহাস।
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও জামায়াত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতা ও স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর দেশটিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে গড়ে ওঠা বিএনপিকে দখল করে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়। যত দিন বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থক প্রবীণ নেতারা ছিলেন তত দিন জামায়াতের এই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। কিন্তু ‘বাপ কা বেটা’ তারেক রহমান সাবালক হয়ে উঠতেই জামায়াতিরা তাঁর কাঁধে ভর করে এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নেতাদেরও একে একে দল থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে।
তারেক রহমান ঘোষণা করেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত একই পরিবারের লোক।’ তাঁর কল্যাণে একাত্তরের ঘাতক ও স্বাধীনতার শত্রুদের গাড়িতে মন্ত্রিত্বের পতাকা ওড়ে। শুরু হয় জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ও ইতিহাসের অবমাননার যুগ। এই যুগের অবসান হয়েছে এবং একাত্তরের শীর্ষ ঘাতকদেরও সাজা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি জামায়াতের কবলমুক্ত হতে পারেনি। অনেকেই বলেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি যদি জেতে, তাহলে জয়টা হবে জামায়াতের, বিএনপির নয়। বিএনপির খোলসে জামায়াত ক্ষমতায় যাবে। শুরু হবে দেশে একাত্তরের চেয়েও ভয়াবহ অত্যাচার। আমাদের একটি সুধীসমাজ এই সত্য জেনেও ‘হালাল গণতন্ত্র’ চেয়ে প্রচ্ছন্নভাবে এই নয়া বর্গিদের সমর্থন দিচ্ছে।
তবু বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটা নীতিগত মিল আছে। জামায়াত মৌলবাদী দল এবং বিএনপি কাছাকাছি সাম্প্রদায়িক দল। ভারতের বিজেপির মতো তারও একটি অসাম্প্রদায়িক নামের খোলস আছে। ভারতে শিবসেনা ও বিজেপির মধ্যে মৈত্রী হতে পারে; কিন্তু কংগ্রেস ও শিবসেনার মধ্যে মৈত্রী হতে পারে না। শিবসেনা হিংস্র মৌলবাদী দল এবং কংগ্রেস সম্পূর্ণ বিপরীত সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দল। অনুরূপভাবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দল এবং জামায়াত শুধু হিংস্র মৌলবাদী দল নয়, স্বাধীনতার শত্রুও। এই দলের নেতাকর্মীদের জন্য আওয়ামী লীগের দরজা খুলে দেওয়া দেশ ও জাতির জন্য ভয়ংকর সর্বনাশের সূচনা করবে।
জামায়াত বিএনপিকে আগে দখল করেছে। এখন বিএনপি ক্ষমতায় নেই। জামায়াতের কাছে তার প্রয়োজন অনেক কম। প্রয়োজন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। তাই পরিকল্পনামতো চলছে দলে দলে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ। আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে সতর্ক হোন। আওয়ামী লীগে অবিলম্বে প্রয়োজন কঠোর শুদ্ধি অভিযান। নইলে আগামী নির্বাচনে জিতেও দেশকে রক্ষা করা যাবে না।
দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতে এবং বাংলাদেশেও সেক্যুলার গণতান্ত্রিক শিবির দুর্বল ও বিভ্রান্ত। কংগ্রেসের নতুন নেতা রাহুল গান্ধী নির্বাচনে জেতার জন্য শিবসেনাদের নীতি অনুসরণ করছেন। তিনি সাম্প্রতিক গুজরাট নির্বাচনের সময় নিজেকে শিবভক্ত ঘোষণা করে প্রতিটি শিবমন্দিরে গিয়ে পূজা দেন। কংগ্রেস ভারতে একটি রামমন্দির তৈরিরও ঘোষণা দিয়েছে। গুজরাটের নির্বাচনে কংগ্রেস ভালো করলেও জয়ী হয়নি। শিবসেনা ও বিজেপির ধর্মীয় রাজনীতির অনুসরণ করে কংগ্রেস আগামী সাধারণ নির্বাচনে জিতবে তার আশা কম। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করতে গিয়ে তাঁর বাহুতেই শক্তি জুগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের শেষ ভরসা, আওয়ামী লীগ এখনো কোনো বালকোচিত নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত নয়। নেতৃত্বে আছে শেখ হাসিনার মতো দীর্ঘদিনের সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব। বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান ‘অনুপ্রবেশের রাজনীতি’ সম্পর্কে শেখ হাসিনা সময় থাকতে সতর্ক হবেন এবং দলের মধ্যে কঠোর শুদ্ধি অভিযান শুরু করবেন—এটা শুধু আমার নয়, সারা দেশের সচেতন ও দেশপ্রেমিক মানুষের আশা। (কালের কণ্ঠের সৌজন্যে)
লন্ডন, সোমবার, ৯ এপ্রিল ২০১৮