![কোটা বনাম মেধা বিতর্ক](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/10/shawshati_134549.jpg)
শাশ্বতী বিপ্লব, ১০ এপ্রিল, এবিনিউজ :
প্রিয় কোটা সংস্কারপন্থী ভাই ও বোনেরা,
আপনাদের অকথ্য গালাগালি শুনেও আবার লিখতে বসেছি। কোটা নিয়ে আরেকবার দুটো কথা বলতে চাই। কারণ আমি জানি যারা ইনবক্সে গালি দিয়েছেন গালি দেয়াই তাদের কাজ। আপনারা আমাদের সন্তানতুল্য। এই যে আপনাদের সঠিকভাবে আমরা গড়তে পারিনি, এই ব্যর্থতা আমারও।
যাই হোক, কোটা নিয়ে আরো কিছু কথা না বলেও পারছি না। কারণ, প্রথমত: আপনাদের সংস্কার প্রস্তাব স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত: যে হারে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রলে টাইম লাইন ভেসে যাচ্ছে সেটা কিছুতেই কাম্য নয়। আপনারা বলছেন যে আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে নন। কিন্তু আপনারা এই ট্রল আটকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং একধরনের ইন্ধন যুগিয়েছে আপনাদের এই আন্দোলন। তৃতীয়ত: মেধাহীনদের নিয়োগ নিয়ে যে উষ্মা আপনারা প্রকাশ করছেন, সেটা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অবমাননাকরও।
আমি তৃতীয় কারণটা নিয়ে প্রথমে একটু আলোকপাত করতে চাই। একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরছি আলোচনার সুবিধার্থে।
- ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলো ৩ লক্ষ ৮৯ হাজার ৪ শত ৬৮ জন। মানে প্রায় ৪ লাখ। অংশগ্রহণের জন্য কোনো কোটা নেই অবশ্যই।
- প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাশ করেছে মাত্র ১৬ হাজার ২ শত ৮৬ জন। এখানেও কোনো কোটা নেই। এই ১৬ হাজার ২ শত ৮৬ জনের সকলে লিখিত পরীক্ষা দেবেন।
- ধরা যাক, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে ১০ হাজার। একটু বাড়িয়েই ধরলাম (৩৭ তম বিসিএস এ লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিলো ৫ হাজার ৩৭৯ জন)। এখানেও কোনো কোটা নেই।
এখন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই ১০ হাজার মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাবে মাত্র ২ হাজার চব্বিশ জন। ঠিক এখানেই কোটা হিসাব করা হবে। ৪ লক্ষ থেকে ১০ হাজারে ঠাঁই করে নেয়া এই তালিকার কাকে আপনি মেধাহীন বলবেন? এরা প্রত্যেকেই মেধাবী এবং চাকরী পাওয়ার যোগ্য নয় কি? আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, এই ১০ হাজারের একজনও কম মেধাবী বা অযোগ্য নয়। সে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হোক বা না হোক, নারী হোক বা না হোক, প্রতিবন্ধী হোক বা না হোক, আদিবাসী হোক বা না হোক।
একজনকেও যদি কোটায় নিয়োগ দেয়া নাও হয়, তবুও এই তালিকা থেকে মেধাবী ৮ হাজার যোগ্য চাকুরি প্রার্থী সরকারি চাকুরি পাবে না। আপনারা যারা কোটাভুক্তদের অযোগ্য বলে, মেধাহীন বলে দাবি করছেন, তারা ঠিক বুঝে বলছেন তো? আমাদের অনেকের চাইতেই অবশ্যই এই কোটাধারীরা অনেক বেশি মেধাবী ও যোগ্য, ভেবে দেখবেন।
এবার আপনাদের ৫টি দাবি একটু আলোচনা করি।
প্রথম দাবি: কোটা ব্যবস্থা ১০% এ নামিয়ে আনতে হবে। যদিও বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তুলনায় ১০% খুবই নগন্য। তবুও এই ১০% এর বিন্যাস কি হবে সেটা আপনাদের দাবিতে পরিস্কার নয়।
দ্বিতীয় দাবি: কোটায় কোনো ধরণের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া যাবে না। এটাও আপনাদের একটু পরিস্কার করা দরকার। সরকারি চাকুরিতে কোথায় বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া হয় জানান। বিসিএস ক্যাডারে এরকম কিছু খুঁজে পেলাম না।
তৃতীয় দাবি: চাকুরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না। এই সুবিধা ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে।
চতুর্থ দাবি: অভিন্ন কাট মার্কস ও বয়স সীমা নির্ধারণ। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ আছে। কাদের জন্য ২ বছর বেশি রাখা হয়েছে, কেন রাখা হয়েছে সেটা পর্যালোচনা হতে পারে।
পঞ্চম দাবি: কোটার শূন্য পদ মেধায় নিয়োগ দিতে হবে। খুবই যুক্তিযুক্ত দাবি এবং সরকারও এরকমই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বলে জানি।
আপনারা আপনাদের প্রচারপত্রে সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১), ২৯ (২) ধারা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সংবিধানের ২৮ (৪) এবং ২৯ (৩) এর ক, খ, গ এড়িয়ে গেছেন বা বুঝতে পারেননি। আপনাদের সুবিধার জন্য আমি তুলে দিচ্ছি।
২৮ (৪) অনুচ্ছেদ: নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।
২৯ (৩) অনুচ্ছেদ: এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই-
(ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে,
রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।
কোটা ব্যবস্থা শুধু সাংবিধানিকভাবেই সুরক্ষিত নয়, বরং জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন যে ঘোষণাপত্র আছে তার দ্বারাও স্বীকৃত। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাটি একটু খুঁজে পড়ে নেবেন প্লিজ।
আন্দোলন করুন, কিন্তু সেটা নিয়ে আগে একটু বিশ্লেষণ করুন। সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করুন এবং কোনো বিশেষ ব্যবস্থা কেন নেয়া হয় সেটাও একটু পর্যালোচনা করুন। তারপর দাবি দাওয়া তৈরি করুন। অকারণে কাউকে অযোগ্য, মেধাহীন বলে গালি দেয়ার আগে ভাবুন প্লিজ। (জাগরণীয়ার সৌজন্যে)
লেখক: তরুণ কবি ও সাহিত্যিক