বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

বেজে উঠেছে কি সময়ের ঘড়ি?

বেজে উঠেছে কি সময়ের ঘড়ি?

সেলিম জাহান, ১২ এপ্রিল, এবিনিউজ : কিছু দিন আগে ডেভিড পিলিং একটি লেখা লিখেছেন। লেখাটির শিরোনাম, ‘সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন চিরনিদ্রায় শায়িত থাক— বলার কি সময় এসেছে?’ লেখাটির ভিত্তি ডেভিডের সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ ‘প্রবৃদ্ধি বিভ্রম’। কয়েক সপ্তাহ আগে এ বছরের অক্সফোর্ড সাহিত্য উৎসবে ডেভিড তার বইটি সম্পর্কে বলেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে আমার দিল-চসপী আছে জেনে আমার লন্ডনপ্রবাসী সতীর্থ বন্ধু কবি শামীম আজাদ ডেভিডের লেখাটি আমাকে পাঠিয়েছিল। বলা বাহুল্য, শামীম নিজেও ওই উৎসবে যোগ দিয়েছিল।

ডেভিড তার লেখায় মূলত পাঁচটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমি সেগুলোর প্রথম চারটির সঙ্গে সহমত পোষণ করি, শুধু শেষটি ভিন্ন। ডেভিডের পাঁচটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে এ রকম— প্রথমত. সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কারণ সে সময়ে পরিকল্পনাবিদদের সামনে একটা বড় প্রশ্ন ছিল, কী করে সামরিক খাতে আরো সম্পদ দেয়া যেতে পারে। এ পর্যবেক্ষণ একদম ঠিক। দ্বিতীয়ত. সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সঙ্গে আমরা যেন মানুষের মঙ্গলকে গুলিয়ে না ফেলি। কোনো দ্বিমত নেই। তৃতীয়ত. সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের জন্য উৎপাদিত সব পণ্যকেই সমভাবে দেখা হয়। কোনো ভুল নেই। চতুর্থত. সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আয়প্রবাহ পরিমাপ করে সত্য কিন্তু অসমতা সম্পর্কে নিশ্চুপ। কে এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করবে? পঞ্চমত. সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে সমাধিস্থ করার সময় এসেছে। হুম! না বন্ধু, এ ব্যাপারে এত দ্রুত চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না।

উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাঁচটি খামতি আছে। প্রথমত. এটা বস্তুগত প্রাচুর্যকে পরিমাপ করে, মানুষের মঙ্গলকে নয়। দ্বিতীয়ত. এটা সব উৎপাদনকে একই নিক্তিতে মাপে এবং সুপণ্যের (যেমন— খাদ্যসামগ্রী) সঙ্গে কুপণ্যের (যেমন কিনা বোমা) কোনো ভেদাভেদ করে না। তৃতীয়ত. সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মোটের ওপর জোর দেয়, বণ্টনের ওপর নয় এবং সেই প্রেক্ষাপটে মানবজীবনের বৈষম্যের চালচিত্রটিকে এড়িয়ে যায়।

১৯৯০ সালে মানব উন্নয়ন চিন্তাধারার প্রেক্ষাপটে এবং মানুষের সক্ষমতা ও সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষকেই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপিত করেছিলাম। সেই প্রসঙ্গ টেনেই আমরা বলেছিলাম, উন্নয়নের মূল কথা হলো, মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন মানে হলো, মানবসম্পদ উন্নয়ন। মানুষের জন্য উন্নয়নের অর্থ হচ্ছে, যে উন্নয়নের সুফল সব মানুষ সমভাবে ভোগ করবে। মানুষের দ্বারা উন্নয়ন, এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয় যে, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানুষ নিষ্ক্রিয় প্রাপকের ভূমিকায় থাকবে না, অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে উন্নয়নকে সঠিক রূপ দেবে।

এর ফলশ্রুতিতে মানবমঙ্গলের একটি পরিমাপক আমরা বের করতে পেরেছিলাম— মানব উন্নয়ন সূচক। সূচকটি তিনটি জিনিসকে সমন্বিত করে— একটি দীর্ঘ ও সুস্বাস্থ্যসম্পন্ন জীবন (প্রত্যাশিত গড় আয়ু দ্বারা পরিমাপিত), জ্ঞান (শিক্ষার অর্জন দিয়ে পরিমাপিত) এবং একটি সুনন্দ জীবনযাত্রা মান (মাথাপিছু আয় দ্বারা পরিমাপিত)। সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মতো মানব উন্নয়ন সূচকও একটিমাত্র সংখ্যা, হয়তোবা সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মতোই স্থূল কিন্তু এটা কোনোভাবেই মানবজীবনের বিস্তৃত দিকগুলোর প্রতি অন্ধ নয়।

সব উৎপাদন ও সব পণ্যকে সমভাবে দেখার দোষে সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যে কতটা দুষ্ট, তার সপক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি দেখিয়েছিলেন প্রয়াত রবার্ট কেনেডি। বহুদিন আগে ১৯৬৮ সালের ১৪ মার্চ কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে নিম্নোক্ত কথাগুলো তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—

‘আমার মনে হয়, খুব বেশি করে এবং বেশ অনেকদিন ধরেই আমরা ব্যক্তিগত উত্কর্ষ ও গোষ্ঠীগত মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু বস্তুগত জিনিস পুঞ্জিত করতেই তত্পর হয়েছি। আমাদের সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদন বর্তমানে বছরে ৮০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেই সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদন দিয়ে যদি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন করি, তাহলে সে উৎপাদন বায়ুদূষণ, সিগারেটের বিজ্ঞাপন এবং সড়কপথে দুর্ঘটনার মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকে গণনা করে। আমাদের গৃহের জন্য ব্যবহূত বিশেষ তালা এবং সেগুলো যারা ভাঙে, তাদের আটকে রাখার জন্য কয়েদখানাও এ গণনার অন্তর্ভুক্ত। বিশাল বনমালার ধ্বংস ও বিশৃঙ্খল টানাহেঁচড়ার কারণে প্রাকৃতিক বিস্ময়কর জিনিসগুলোর হারিয়ে যাওয়াও এ গণনার অংশ। এ উৎপাদন নাপাম বোমা, পারমাণবিক অস্ত্র এবং আমাদের নগরীর দাঙ্গা প্রতিরোধের জন্য ব্যবহূত সশস্ত্র যানগুলোকেও গণনার মধ্যে নিয়ে আসে। রাইফেল, ছুরি ও শিশুদের কাছে আরো বেশি বিক্রির লক্ষ্যে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যে সহিংসতাকে মহিমান্বিত করা হয়, এ সবকিছুকেই সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদন গণনার আওতায় নিয়ে আসা হয়।

কিন্তু যা এ উৎপাদন গণনায় বিবেচনা করা হয় না, তা হচ্ছে আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য, তাদের শিক্ষার গুণ কিংবা তাদের খেলার আনন্দ। এ উৎপাদন গণনা আমাদের কবিতার সৌন্দর্য কিংবা আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের শক্তি অথবা আমাদের গণবিতর্কের ধীশক্তি বা আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের সততাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। এটা আমাদের বুদ্ধির দীপ্তি কিংবা আমাদের সাহসের পরিমাপ করে না, মূল্যায়ন করে না আমাদের প্রজ্ঞা কিংবা আমাদের জ্ঞানের, গণনা করে না আমাদের আবেগ কিংবা জন্মভূমির প্রতি আমাদের নিষ্ঠার। সংক্ষেপে সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদন সবকিছুই পরিমাপ করে, শুধু সেসব বিষয় ব্যতীত, যা জীবনকে অর্থময় করে তোলে।’

এটা সত্যি যে, বব কেনেডি যতগুলো বিষয়ের সপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন, তার সবকিছুই মানব উন্নয়ন সূচকের মধ্যে নেই। কিন্তু সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যেসব বিষয়কে প্রতিফলিত করে, নিশ্চিতভাবে মানব উন্নয়ন সূচক তার চেয়ে জীবনের অনেক তাত্পর্যময় জিনিসগুলো ধারণ করে।

মানব উন্নয়ন সূচক মানবমঙ্গলের মধ্যে যে বৈষম্য বা অসমতা আছে, তাকে প্রতিফলিত করতে পারে, যেটা সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পারে না। বৈষম্য বা অসমতা আমাদের সময়কালের সবচেয়ে বড় বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বিত্তবান আট ব্যক্তির ধনসম্পদ বিশ্বের নিচার্ধ ৫০ শতাংশ জনসংখ্যার সমান। এর মানে দাঁড়াচ্ছে ওই আটজনের একেক জন ৪৬২ মিলিয়ন লোকের সমতুল্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন নয়, মানব উন্নয়ন সূচকই মানবমঙ্গলের একটি অর্থবহ পরিমাপ হতে পারে। অসমতা-সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচক প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিক্ষার অর্জন, মাথাপিছু আয়ের বৈষম্যকে তুলে ধরে এবং দেখাতে পারে যে, এ অসমতাগুলোর কারণে গড় মানব উন্নয়ন সূচকের কতখানি খোয়া যায়।

তবু যেহেতু সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গণনা করে, বস্তুগত বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল্যায়ন করে, সুতরাং অর্থনীতির পরিমাপক হিসেবে এর প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করা যায় না। মানব উন্নয়ন সূচকের একটি দিক হিসেবে এটি একটি সুনন্দ জীবনমানকে প্রতিফলিত করে। মানব উন্নয়নের জন্য আয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপান, যদিও এটা কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানবমঙ্গলের জন্য আয় একটি আবশ্যকীয় শর্ত কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। সুতরাং ডেভিড পিলিং যে যুক্তি দেখিয়েছেন, সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শান্তিতে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকুক, তা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। গামলার জলের সঙ্গে সঙ্গে শিশুকেও বাইরে ছুড়ে ফেলাটা ঠিক হবে না। (বণিক বার্তা)

লেখক : নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত