
ঢাকা, ১২ এপ্রিল, এবিনিউজ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি সরকারের অর্থ সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
তিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার ছিলেন। কিছু সময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছে তিনি। তার বেশ কয়েকটি প্রকাশনা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ ও ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাম্প্রতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন : কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে যে আন্দোলন চলছে এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ড. আকবর আলি খান : কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। তবে এটা যদি হিংসাত্মক আন্দোলন হয় তাহলে উদ্যোক্তাদের এটা নিয়ে বিবেচনা করার দরকার রয়েছে যে, এ আন্দোলনে হিংসার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা। আমি মনে করি, সরকার মুক্তমন নিয়ে বিবেচনা করলে কোটা পদ্ধতিতে অবশ্যই সংস্কার সাধিত হবে। আমি আশা করব সরকার বিষয়টি পর্যালোচনা করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যদি মুক্তমন নিয়ে করে, তাহলে কোটা পদ্ধতিতে অবশ্যই অনেক পরিবর্তন আসবে।
প্রশ্ন : কোটা পদ্ধতি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে কি সাংঘর্ষিক?
আকবর আলি খান : কোটা পদ্ধতি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কোটা দেয়ার বিধান সংবিধানে আছে। কিন্তু সে কোটা দিতে হবে শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ছাড়া যদি অন্য কাউকে কোটা সুবিধা দেয়া হয় তাহলেই সেটা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
প্রশ্ন : আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোটা পদ্ধতির ব্যবহার কী পর্যায়ে রয়েছে?
আকবর আলি খান : ভারতে কোটা পদ্ধতি আছে। কিন্তু সেখানকার সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পর কোটা পদ্ধতিতে সেখানে যে দুর্বলতাগুলো ছিল, সেটা দূর করা সম্ভব হয়েছে।
প্রশ্ন : সরকার বলছে, যৌক্তিকভাবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। আপনার দৃষ্টিতে যৌক্তিক সংস্কারটি কেমন হওয়া উচিত?
আকবর আলি খান : কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যখন এই কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তখন বাংলদেশে ১৭টি জেলা ছিল। এ ১৭টি জেলায় শুধু মুক্তিযোদ্ধা এবং জেলা কোটা হিসেবে দুটি কোটার প্রবর্তন করা হয়।
আর মেধাভিত্তিক কোটা হিসেবে মোট ৩৫টি কোটা ছিল। তারপর আশির দশকে দেশে ৬৪টি জেলা করা হয়। এর পর আরও ৪টি কোটার প্রবর্তন করা হয়। এগুলো হল জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, উপজাতি কোটা এবং মহিলা কোটা। সব মিলিয়ে বর্তমানে কোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫৭টি। অবশ্য যারা পঙ্গু তাদের জন্য যে সুবিধা দেয়া হয়েছে যদি সে কোটাটি এর সঙ্গে যোগ করা হয় তাহলে ২৫৮টি হবে। তবে এদের ক্ষেত্রে কোটা বাধ্যতামূলক নয়।
সুতরাং আমরা মোট কোটা হিসেবে ২৫৭টিকেই ধরতে পারি। এরকম ২৫৭টি কোটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। চাকরির ক্ষেত্রে যেখানে ২০টি বা ৫০টি পদ থাকে, সেখানে ২৫৭টি পদ ভাগ করা অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই এটা অবশ্যই সংস্কার করা উচিত।
প্রশ্ন : জেলাভিত্তিক কোটা পদ্ধতি বহাল রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু আছে বলে আপনি মনে করেন।
আকবর আলি খান : বর্তমানে যমুনা সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলই কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই এখন আর জেলাভিত্তিক কোটার কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও যদি জেলাভিত্তিক কোটা সরকারের পক্ষে বাতিল করা সম্ভব না হয়, তাহলে এটাকে জেলাভিত্তিক পর্যায় থেকে বাদ দিয়ে বিভাগভিত্তিক পর্যায়ে প্রবর্তন করলে কোটার সংখ্যা ৩৭-৩৮-এ নেমে আসবে, যেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বর্তমানে যে ২৫৮টি কোটা আছে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে শামসুল হক কমিশনের রিপোর্টে বিস্তারিত লেখা আছে।
প্রশ্ন : কোটার ভেতরে কোটা রয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আকবর আলি খান : মেধা কোটার বাইরে চাকরি পেতে হলে প্রথমে আমাদেরকে জেলা কোটায় কোয়ালিফাই করতে হয়। মহিলা কোটা সেই জেলা কোটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ কোটার ভেতরে কোটা আছে। এটাকে যদি তুলে দিয়ে ১০ শতাংশ মহিলা প্রার্থীদের সারা বাংলাদেশ ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং উপজাতিদেরও যদি অনুরূপভাবে নির্বাচন করা হয়, তাহলে কোটা পদ্ধতির যে খারাপ প্রভাব সেটা অনেকাংশে কমে যাবে।
প্রশ্ন : মোট কত শতাংশ কোটা থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
আকবর আলি খান : দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৫ শতাংশ কোটা রয়েছে। আমাদের সংবিধানের মূলনীতির চেয়ে কোটার পরিমাণ বেশি হতে পারে না। এ ব্যাপারে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে যে, ৫০ শতাংশের বেশি কোটা বহাল রাখা যাবে না। ভারতের সর্বত্র সেটা কার্যকর করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশে বর্তমানে যে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে সেখানে ৫ শতাংশ কোটা হ্রাস করতে হবে।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা কোটা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
আকবর আলি খান : মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো জনগোষ্ঠীকে পুরস্কার দেয়ার জন্য কোটা প্রবর্তন করা হয়নি। সংবিধানে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। যদি কেউ করতে চায় তাহলে সংবিধান পরিবর্তন করে তবেই করতে হবে। আমাদের সংবিধানে একমাত্র অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে কোটা দেয়ার বিধান রয়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধা যারা আছেন, তাদের মধ্যে যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা এবং সরকারের ভাতার ওপর নির্ভরশীল মুক্তিযোদ্ধা- তাদেরকে আমরা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরতে পারি এবং তারাই কোটার অধিকারী। সুতরাং কোটা সব মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পাওয়া উচিত নয়। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার সন্তানদের জন্য কোটা দাবি করার তো কোনো মানে হয় না।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মের পরের প্রজন্মকে কি কোটা সুবিধা দেয়া যেতে পারে?
আকবর আলি খান : আমি আগেই বলেছি, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীই কোটা পাওয়ার অধিকারী। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা যদি পিতার আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে তাদেরকে কোটা দেয়া যেতে পারে। তবে সেটা তৃতীয় প্রজন্মের পরের প্রজন্মকে নয়। সরকার যদি এটি মেনে নেয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোটা প্রার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
প্রশ্ন : কোটা কি চিরস্থায়ী কোনো ব্যবস্থা?
আকবর আলি খান : না, কোটা কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। কোটা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য করা হয়। যেমন ধরুন আমাদের সংসদে মহিলাদের জন্য কোটা আছে। সেই কোটা কিন্তু চিরন্তনভাবে করা যায়নি। কোটা ১০ বা ১৫ বছরের জন্য করা হয়, পরবর্তীকালে সেটাকে পর্যালোচনার আওতায় আনতে হয়। পর্যালোচনায় আনার ফলে কোটার মধ্যে যে ভুলভ্রান্তিগুলো আছে সেটা বেরিয়ে আসবে এবং এগুলো অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে। এ সবকিছুই আমি আমার বই THE `RESHAM'S LAW SYNDRONE AND BEYOND-এ বিস্তারিতভাবে লিখেছি।
প্রশ্ন : কোটা পদ্ধতিকে ব্যবহার করে অনেকে জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে, এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আকবর আলি খান : যেহেতু অতিমাত্রায় কোটা পদ্ধতি বহাল রয়েছে, সেহেতু এখানে জাল-জালিয়াতির সুযোগ থাকতেই পারে। যদি এর সংস্কার করা হয় তাহলে এই জাল-জালিয়াতির বিষয়টিও অনেকাংশেই কমে যাবে। (দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে)
এবিএন/সাদিক/জসিম