
এস এম মনসুর নাদিম, ১৪ এপ্রিল, এবিনিউজ : বাংলা নব বর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ। বাংলা ও বাঙালির লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক এই মাস আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন– প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্রদীন একাকী, কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ। সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ। সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ। বৈশাখ চিরদিনই রুদ্র। প্রাচীন কবি, সাহিত্যিক দ্বারা বৈশাখের রুদ্র প্রকাশিত হয়েছে মধ্যযুগের সাহিত্যেও। পহেলা বৈশাখ পুরোন বিদীর্ণ খোলসকে বাদ দিয়ে অগ্রগামী হওয়ার দুর্বার ইচ্ছা নববর্ষকে বরণের বিপুল উদ্দিপনার মধ্যে নিজের সংস্কৃতির প্রতি বিনম্র ভালোবাসা প্রকাশিত হয়।
বাংলা সনের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ। এই পহেলা বৈশাখ বাক্যটাতে আমার গুরুতর আপত্তি রয়েছে। যেমন রয়েছে, ১লা (পহেলা) জানুয়ারি, ২রা (দোসরা) ফেব্রুয়ারি, ৩রা (তিসরা) মার্চ ইত্যাদি বাক্য বা শব্দ ক’টিতে। পহেলা, দুসরা, তিসরা ও চৌঠা (চৌথা) এই শব্দ গুলি বাংলা নয়। পাকিস্তান আমলে এই উর্দু–ফার্সি শব্দ গুলি ব্যবহার হতো উর্দু– বাংলার সংমিশ্রণে। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরও কেন আমরা আজও ১ম (প্রথম) বৈশাখ, ২য় জানুয়ারি, ৩য় মার্চ বলতে পারছি না? শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা সর্বত্র বাংলা চালুর কথা বলে থাকি। ষোল আনা বাঙালি শুধু পান্তা ইলিশ খেলে হওয়া যায় না। এই পান্তা ইলিশ খাওয়া বাংলা নব বর্ষের কোন ঐতিহ্য না। যারা বর্ষ বরণে পান্তা ইলিশ খাওয়ার প্রচলন করেছে তারা একদিকে বাঙালির চিরাচরিত ঐতিহ্য কে ধ্বংস করেছে অন্যদিকে জাটকা নিধন করে আমাদের জাতীয় মৎস্য ইলিশকে নিশ্চিহ্ন করার মতো ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। তাই নব বর্ষে ইলিশ বর্জন করুন। যারা নব বর্ষে ইলিশ ভোজন করেন তারা ষোলআনা বাঙালি হতে পারে না। বাংলা নব বর্ষে আসুন আমরা শপথ করি বাংলাকে বাংলার মতোই বলবো। বাংলাকে বাংলার মতই লিখবো। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারোমাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথমদিন বাংলা শুভ নব বর্ষ। আসাম, বঙ্গ, কেরেলা, মনিপুর, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাডু ও নেপাল এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। সুতরাং বাংলা নব বর্ষ আমাদের উপমহাদেশে একটি সার্বজনীন সামাজিক উৎসব। এই উৎসবে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। এটা একক কোন হিন্দুর অনুষ্ঠান না, কিংবা একক কোন মুসলমানের অনুষ্ঠান নয়। নয় কোন খৃষ্টান কিংবা বৌদ্ধের একক অনুষ্ঠান। এটা ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে বাঙালির অনুষ্ঠান। যার যেভাবে খুশি এই অনুষ্ঠান উদযাপন করবে। এখানে অহেতুক ধর্মকে টেনে এনে জল ঘোলা করা কারোরই উচিৎ নয়। তবে কুসংস্কার যেন এই আনন্দ ঘন অনুষ্ঠানকে স্পর্শ করতে নাপারে সেদিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা অতীব প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নববর্ষ নিয়ে মানুষের মাঝে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যদিও এই সমস্ত ধারণার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। তারপরও এই সব অযৌক্তিক ভ্রান্ত ধারণা সমূহ মানুষ মেনে আসছে যুগ যুগ ধরে। যেমন অনেকে মনে করে, এইদিনে যা করবে, বা যা খাবে, সারা বছরই তা করবে বা তা খেতে পারবে। তাই তারা ঐদিন মিষ্টি, সুস্বাদু ফল–মূল বিরিয়ানি ইত্যাদি ভালো ভালো খাবার খেতে দেখা যায় এবং পরস্পর পরস্পরের সাথে অত্যন্ত সৌহার্দ্য পূর্ণ আচরণ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতিও কিন্তু এক নয়। কিছু কিছু মিল থাকলেও নব বর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ হয় দেশীয় ঐতিহ্য। নববর্ষের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বর্ষবরণ করা হয়। এগুলোর মাঝে কিছু চমকপ্রদ মজার প্রথা প্রচলিত আছে। এবার তা কিঞ্চিৎ আলোচনা করবো। যেমন থাইল্যান্ডের লোকেরা একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। মেক্সিকোর অধিবাসীরা রাত বারোটার সঙ্গে সঙ্গে বারোবার ঘন্টা বাজায়। এ সময় প্রতি ঘন্টা ধ্বনির সঙ্গে একটি করে আংগুর খায়। এবং তারা বিশ্বাস করে এই সময় যা কামনা করা হয়, তাইই পূরণ হয়। কোরিয়াতে নববর্ষ উদযাপনের সময় কেউই ঘুমায়না। তাদের বিশ্বাস এই সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়। রাত বারোটার সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে তেত্রিশবার ঘণ্টা বাজানো হয় কোরিয়ার তেত্রিশ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। নববর্ষের সুপ্রভাতে কোরিয়ানরা প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে, এবং সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়। ব্রাজিলিয়ানরা রি ও ডি জেলিরো সমুদ্র সৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি করে থাকে। এর অন্যতম আকর্ষণ চোখ ধাঁধানো আতশবাজি প্রদর্শনী। এদিন অধিকাংশ লোকই সাদা পোশাক পরিধান করে থাকে। তাদের বিশ্বাস সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুঁড়ে দিলে বছরটি খুব ভালো কাটবে। আর্জেন্টিয়ানরা নববর্ষের আগেরদিন রাত্রে পরিবারের সকল সদস্য একসঙ্গে আহার করে। তারপর বড়রা নাচের অনুষ্ঠানে চলে যায়। ভোর পর্যন্ত চলে এই নাচের অনুষ্ঠান। নববর্ষের প্রথমদিন নদী বা পুকুরে সাঁতার কেটে তারা নববর্ষ উদযাপন করে। আমরা নববর্ষ উদযাপন করি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে। যেমন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করে। গান বাজনা, নানা সাজে সজ্জিত, নানা রঙে বর্নিল পোস্টার ব্যানার এবং পান্তা ইলিশ খেয়ে। যাদের ইচ্ছা হবেনা মঙ্গল প্রদীপ জ্বালাবে না, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবে না, এক্ষেত্রে কেউ কাওকে তো বাধ্য করছে না। সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এটার বিরোধিতা করা সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয়। আমি আগেই বলেছি, বাংলা নববর্ষ কোন ধর্মীয় উৎসব নয়। এটি বাঙালি জাতির কৃষ্টি সভ্যতা ও ঐতিহ্যের মেলা। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুধু এক জায়গায় একই ঢং এ করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। কেউ ইচ্ছা করলে অন্যত্র নিজেদের মত করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করা যায়। সেখানে মিলাদ পড়াতে পারেন, হামদ–নাত ও খতমে কোরআন সহ কাঙালি ভোজ করা যায়। অন্যের অনুষ্ঠানে গিয়ে পানিকে জল কেন বললে ? কিংবা জলকে পানি কেন বললে ? এই জাতীয় বিতর্ক, মানে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধানো যা কারো কাম্য নয়। সুতরাং এখানে ধর্মের ব্যবহার ধর্মকেই খাটো করা। ঐতিহাসিক সত্য হল, চতুর্দশ শতকের প্রথমদিকে মোগল সম্রাট আকবর এর সময় থেকেই রাজস্ব আদায় উপলক্ষে বাংলা নববর্ষ দিবসটি বাংলা সন গননার জন্য শুরু হয়। যখন বাংলা সন প্রথম চালু হয়, এতদ অঞ্চল তখনো বাংলা বা ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত ছিলনা। অভিহিত ছিল বঙ্গ বা নামে। মোগল শাসকদের আমলেই পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের উপকুলীয় বিভাগ এক ঐক্যবদ্ধ শাসনের অধীনে শাসিত হয়। বাংলা সনের ও উৎপত্তি তখন থেকেই। ইতিহাস সাক্ষী দেয় সম্রাট হোসেন শাহ্? এর আমল থেকেই বাংলা ভাষা তাঁর রাজদরবারে প্রথম স্থান পায়। তাদের পৃষ্ঠ পোষকতায় বাংলাভাষার চর্চা ও ভাষাগত ঐক্য ও জাতীয় সংস্কৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের নববর্ষের উৎসবের দিনটি গ্রাম বাংলায় ‘পরব’ (পার্বণ) হিসেবে পালিত হয়। আর এই পার্বণ অর্থ আনন্দ উৎসব। সুতরাং আনন্দ উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা কোন কালে কোন ধর্মে নিষেধ ছিল না, এখনো নেই। তবে আনন্দ প্রকাশটা যেন অবশ্যই শালীনতা বিবর্জিত না হয়। কোন ধর্মকে যেন কটা করা না হয়। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত দেয়া না হয়। যাকে বলে নির্মল আনন্দ।
বিদেশী সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে যতই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, দেশজ সংস্কৃতি মিশে আছে রক্তধারার সাথে। নববর্ষ শব্দটার সাথে মিশে আছে নতুনত্বের আমেজ। নানাদিক থেকে দিনটিকে বাঙালির জীবনে একটি আলাদা দিনে পরিণত করেছে। তাই পয়লা বৈশাখ এই বাংলার হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান সব ধর্মের বাঙালিদের উৎসবের দিন।
লেখক : কবি ও কলাম লেখক।
(সংগৃহীত)