বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

গ্রামীণ বনাম নাগরিক নববর্ষের চরিত্রভেদ : আহমদ রফিক

গ্রামীণ বনাম নাগরিক নববর্ষের চরিত্রভেদ : আহমদ রফিক

ঢাকা, ১৪ এপ্রিল, এবিনিউজ : বৈশাখী নববর্ষ মনে করিয়ে দেয় গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশ দশকে অশ্বত্থবটের নিবিড় ছায়ায় গ্রামবাংলায় পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন, প্রধানত বিচিত্র পণ্যসমৃদ্ধ মেলার উৎসব-অনুষ্ঠানে। সে মেলার বিকিকিনিতে শিশু-কিশোর, কিশোরী-তরুণ-তরুণী বা গৃহবধূসহ সবার উৎসাহী অংশগ্রহণ। বাদ যেত না চাষের সরঞ্জাম কেনায় ব্যস্ত কৃষকের উপস্থিতি।

কী নেই সেই মেলায়। বাঁশি, খেলনা, পুতুল, পোড়ামাটির ঘোমটাপরা ছোট্ট বউ কিংবা বর-বধূ মূর্তি, নানারঙা বেলুন, রঙিন ফিতা, রকমারি চুড়ি, কানের দুল, শাড়ি ও ফ্রক। অন্যদিকে নানা স্বাদের বাহারি মিষ্টি, এমনকি সোডার পানীয় বোতল, মিষ্টি রঙিন শরবত। এক কথায় খাদ্যপানীয় থেকে রকমারি পণ্য, ছোটদের খেলার সামগ্রী। প্রয়োজন ও বিনোদনের কেনাকাটা এক দিনের হলেও বছরভর শিশু-কিশোরদের, এমনকি তরুণ-তরুণীদের এই দিনটির জন্য কী অপেক্ষা! সেই সঙ্গে কেনাকাটার জন্য বছরভর পয়সা জমানো।

এ উৎসব-অনুষ্ঠানটি এক দিনের জন্য হলেও এই ঐতিহ্যবাহী সময়-সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা গ্রামীণজীবনে বছরজুড়ে উপস্থিত। অর্থাৎ গ্রামীণজীবনের পারিবারিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ বাংলা মাস বছরের হিসাবে বৈশাখ থেকে চৈত্রে। গ্রামীণ জনতা এ হিসাবে চলতে অভ্যস্ত দীর্ঘকাল থেকে। ধান-দূর্বা, খই-কলা, দই-চিঁড়া, পাকা রুইয়ের তত্ত্ব থেকে বহু কিছু নিয়ে তার লোকসংস্কৃতির প্রকাশ। তাতে আড়ম্বরের চেয়ে আন্তরিকতা বড় এবং সম্প্রীতির প্রকাশ প্রধান, আর তা ধর্ম সম্প্রদায়-নির্বিশেষে। গ্রামে কোনোকালে এমন অভিযোগ ওঠেনি যে নববর্ষ অনুষ্ঠান ইসলামবিরোধী। তেমনি বৈশাখী অনুষ্ঠানটি চরিত্র বিচারে শ্রেণি-নির্বিশেষ।

পুঁজিবাদ ও নগরসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নান্দনিক দুদিক থেকেই গ্রাম-নগরের বৈষম্য বাড়তে থাকে, বিনোদনেরও চরিত্রে বদল ঘটে। ক্রমেই গ্রাম ওঠে যেতে শুরু করে শহরে-নগরে-রাজধানীতে। মূলত অর্থনৈতিক চাপে একটু সচ্ছল জীবনযাত্রার তাগিদে। সে আকাঙ্ক্ষা যথাযথ মাত্রায় পূরণ হোক বা না হোক, জীবনের লড়াইটা চালু রাখতে পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ মিলছে না।

রবীন্দ্রনাথের কালে তাঁর অভিজ্ঞতায় ‘গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে, শহর আধুনিক যুগে।’ দুয়ের বৈষম্য-ব্যবধান অবিশ্বাস্য মাত্রার। সেই অবস্থার তুলনামূলক বাস্তব ব্যবধান কালান্তরেও বাড়ছে বৈ কমছে না—প্রমাণ গ্রামের ভূমিহীন কৃষকের ব্যাপক সংখ্যা বৃদ্ধি। তার দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির হিসাবে সঠিকভাবে তুলনামূলক বিচার করতে হবে প্রাত্যহিক পণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তাতেই দেখা যাবে মজুরি বৃদ্ধির পাশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কী ফারাক! ডাল-ভাতের রাজনৈতিক স্লোগানে কৃষক ভোগ্য ডালের অবিশ্বাস্য দাম হেঁচকি তোলার মতো। দুই আনা সের মসুর ডাল এখন ১২০ টাকা কেজি। সে অনুপাতে কি তার দিনমজুরি বেড়েছে?

দুই.

গ্রাম-নগরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধানের কথা আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় নয়। বরং সাংস্কৃতিক দিকের বিভেদটাই বিবেচ্য এবং সেটা রাজধানীতে বৈশাখী নববর্ষের সমারোহ ও ঘনঘটাসহ আবেগের প্রেক্ষাপটে। আগেই বলেছি, গ্রাম উঠে আসছে রাজধানীতে। সেই সঙ্গে নাগরিক সংস্কৃতির হাতে ছিনতাই হয়ে গেছে গ্রামীণ পহেলা বৈশাখ, তার ঐতিহ্যবাহী উৎসব-অনুষ্ঠান ও বিচিত্র পণ্যঠাসা মেলা।

আজ পহেলা বৈশাখ। তপ্ত বৈশাখে (আজ অবশ্য অন্য বছরের তুলনায় পহেলা বৈশাখ ততটা অগ্নিঝরা নয়) রমনার রাজপথজুড়ে লাখো বাঙালির নৃত্যচঞ্চল উন্মাদনা। ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আবেগে আকাশের দিকে মুঠো হাত ছুড়ছে মানুষ। কণ্ঠে গান, স্লোগান। আর চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তাবেষ্টিত এগিয়ে চলা। বাঙালিয়ানার ঐতিহ্যবাহী আবেগের উগ্র প্রকাশ। এর সঙ্গে গ্রাম বৈশাখীর একদাচিত্রের সঙ্গে কোনো মিল নেই।

রাজধানীতে বৈশাখী উদ্যাপন বর্ণাঢ্য রূপ নিয়ে চলুক, তাতে আপত্তির অবকাশ নেই। তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা কেউ কেউ বলে থাকেন, অত্যধিক উগ্রতা কী সংস্কৃতিতে, কী রাজনীতিতে কোথাও খুব একটা আকাঙ্ক্ষিত নয়। যেমন—জাতীয়তাবাদের উগ্রতা, যা ফ্যাসিবাদী নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয়। তবু পহেলা বৈশাখের প্রবল উত্তেজনা ও বাঙালিয়ানার প্রকাশ মেনে নিয়েও বলি, পরবর্তী সময়ে কোথায় চলে যায় সে বাঙালিয়ানার আবেগ। অর্থাৎ কিভাবে চলে বছরের বাকি দিনগুলো?

সরকারি ও বেসরকারি সব ক্ষেত্রে অর্থাৎ জাতীয় জীবনের সর্বত্র জেঁকে বসে থাকে বিগত ঔপনিবেশিক রাজভাষার সংস্কৃতি, তার খ্রিস্টীয় মাস-বছরের তারিখগুলো নিয়ে। সেখানে বাংলা মাস-তারিখের কোনো জায়গা নেই। আবাসন খাত থেকে সর্বত্র খ্রিস্টীয় দিন-তারিখ ও নামগুলোতে সাবেক রাজভাষা ইংরেজির প্রাধান্য।

এই যে রাজভাষা সংস্কৃতি, এতে বাঙালিয়ানার প্রকাশ কোথায়? রমনা প্রাঙ্গণে বা অন্যত্র এক দিন ইলিশ-পান্তা বা শুঁটকি-পান্তা খাওয়ার মানসিক বিলাসিতায় বাঙালিয়ানা বা জাতীয় চেতনার যথার্থ প্রকাশ ঘটে না। এ সবই ‘এক দিনকা সুলতান’-এর মতো উদ্ভটত্বের প্রকাশ ঘটায়। সারা বছরের কর্মকাণ্ডে প্রকট হয়ে থাকে ইংরেজি-সংস্কৃতির ছাপ। তাই ভাষা আন্দোলনের বাঙালি চেতনা প্রকাশ পায় ৮ই ফাল্গুনের পরিবর্তে একুশে ফেব্রুয়ারিতে। একইভাবে বাঙালি জাতীয়তার প্রকাশ ঘটে ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বরের দিন-তারিখে। বাংলা মাস-তারিখ সেখান থেকে নির্বাসিত। এ স্ববিরোধিতা অস্বীকারের উপায় নেই।

একইভাবে আবাসন খাত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণে একদা বাঙালিয়ানা অবসর নিয়েছে (ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে নামকরণে ছিল প্রবল ভাষিক বাংলার প্রকাশ) বর্তমানে ব্যাপক ইংরেজি নামকরণে বা তেমন বিজ্ঞাপনে। আবাসনের নাম যদিবা হয় বাংলা (যেমন-রজনীগন্ধা), তা লেখা হয় ইংরেজি অক্ষরে (Rajanigandha)। প্রকাশ করে আমাদের একদা রাজভাষা সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধতা।

ইদানীং স্বাধীন বাংলাদেশে সে মুগ্ধতার প্রকাশ সমাজে, জীবনাচরণে বেড়েই চলেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এর মহামারি রূপ। সে কথা বাদ দিলেও দেখি নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজেও বাংলাবিষয়ক হীনম্মন্যতার প্রকাশ দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কষ্টসাধ্য ইংরেজি নামকরণে, অথবা ইংরেজি-বাংলার উভয় মিশ্র নামকরণে। উনসত্তর-সত্তরের ঠিক বিপরীত রূপ। একে কি বাঙালি সংস্কৃতির বা ভাষিক সংস্কৃতির সর্বজনীন প্রকাশ বলা যাবে? বিজ্ঞাপনে, নামফলকে, বিলবোর্ডে একই অবস্থা। এমনকি বিয়ের কার্ডও লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। সে কার্ডের শোভায় মূল্যবান আভিজাত্যের প্রকাশ! জাতীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত বৈশাখী নববর্ষ উদ্যাপনের প্রবল বাঙালিয়ানার চারিত্রের সঙ্গে এসব প্রবণতার তুলনামূলক বিচার করতে গেলে বাঙালি-সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত স্ববিরোধই প্রকট হয়ে উঠবে। প্রকাশ করবে জাতীয়তাবোধের ফাঁপা, ভেজাল চরিত্র। এ ছাড়া রাজধানীর বৈশাখী উৎসব শ্রেণি-চরিত্র বিচারে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের অনুষ্ঠান বৈ কিছু নয়। এ অনুষ্ঠানে কি দেখা যায় রাজধানীর বস্তিবাসী নাগরিক বা নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের? তবে মেলার ছোটখাটো দোকানি বা মাটির তৈরি শিল্পপণ্যগুলোর বিক্রেতা মৃৎশিল্পী বা ব্যবসায়ীরা হয়তোবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তা সত্ত্বেও গ্রামের তুলনায় রাজধানীর নববর্ষের অনুষ্ঠানটি একান্তই মধ্যবিত্ত বা তদূর্ধ্ব শ্রেণির আত্মপ্রসাদী শ্রেণি কর্মযজ্ঞ।

রাজধানীর বাংলা বর্ষবরণে সংশ্লিষ্ট মঙ্গল শোভাযাত্রাও প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এতে রয়েছে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা। হয়তো তাই এ শোভাযাত্রা এর মাঙ্গলিক চরিত্রের প্রতীকীরূপের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। মেনে নেওয়া হয়েছে এর অমঙ্গলবিরোধী, অশুভ শক্তিবিরোধী চরিত্র।

কিন্তু এ সবই সম্ভবত শ্রেণি বিশেষের সাংস্কৃতিক-নান্দনিক স্বার্থের টানে। এককথায় রাজধানীর বৈচিত্র্যসন্ধানী মধ্যবিত্ত, বিশেষত এলিট মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণির, বিশেষভাবে এসব শ্রেণির তরুণ ও যুবক শ্রেণির সাংস্কৃতিক রোমান্টিকতার আকর্ষণে। সংস্কৃতির ভিন্নতর চর্চায়। সাংস্কৃতিক আত্মপ্রসাদ নিয়ে আত্মপ্রসাধনে বর্ণময় হয়ে ওঠার গর্ব, গৌরব ও অহংকারের আস্বাদ গ্রহণ এ বর্ণাঢ্য নাগরিক নববর্ষ উদ্যাপনে প্রধান নান্দনিক লক্ষ্য বলে ভাবা যেতে পারে। সংক্ষেপে ইঙ্গিতে আগেও বলেছি, আবারও বলি, ঢাকা মহানগরে এ জমকালো ও রূপময় বৈশাখী নববর্ষের আবেগময় উদ্যাপনে বহিরঙ্গের আনুষ্ঠানিকতাই প্রধান, শ্রেণি বিশেষের নান্দনিক আভিজাত্যের প্রকাশই বড় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সীমাবদ্ধতা ও স্ববিরোধিতা বিস্তর। শ্রেণি-চেতনার গর্বিত প্রকাশও ততোধিক।

এতে কেউ যদি সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির ভোগবাদী চরিত্রের উগ্র আধুনিকতার প্রতিফলন দেখতে চান, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তা কি শতভাগ ভুল প্রমাণ করা যাবে। সীমাবদ্ধতার প্রকাশ যেমন মহানাগরিক শ্রেণি বিশেষের ঐকান্তিক অংশগ্রহণে, তেমনি একই প্রকাশ নিম্নবর্গীয়দের, এমনকি নিম্নবিত্ত শ্রেণিরও অনুপস্থিতিতে (এখানেই গ্রামীণ নববর্ষের সঙ্গে চারিত্রিক গরমিল)।

আর স্ববিরোধিতা? পূর্বোক্ত উল্লেখ ছাড়াও বড় স্ববিরোধিতা যেমন এর এক দিনকা চরিত্রে ও পরদিন থেকে বিপরীত জীবনাচরণে, তেমনি স্ববিরোধিতার তাত্পর্যপূর্ণ প্রকাশ ভাষিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এর বিপরীত চর্চায়। অর্থাৎ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ভাষিক জাতীয়তার ব্যাবহারিক প্রকাশকে দূরে ঠেকিয়ে রেখে সাবেক ঔপনিবেশিক রাজভাষা সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা ও প্রকাশকে জীবনের সর্বমহলে আপন করে নেওয়া স্ববিরোধিতার প্রকাশ বৈ অন্য কিছু নয়।

এ ধারায় সবচেয়ে কৃত্রিম, ফ্যাশনতাড়িত প্রকাশ দামি সুদৃশ্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে একবেলার জন্য পান্তা-ইলিশ বা পান্তা-ভর্তা খাওয়া। এতে নাগরিক বা গ্রামীণ দুস্থ শ্রেণির খাদ্যচর্চা তথা দারিদ্র্যজনিত, বাধ্যতামূলক লবণ-পান্তা খাওয়ার সংস্কৃতির প্রতি পরিহাস বলে কেউ যদি অভিযোগের আঙুল তোলে, তাহলে তাকে একেবারে ভুল বলা যুক্তিসংগত হবে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সাংস্কৃতিক সহানুভূতির পর্যায়ে পড়ে না। একে শ্রেণি বিশেষের সঙ্গে নান্দনিক অংশীদারিও বলা যাবে না। কারণ শ্রেণিগত বিচারে সাংস্কৃতিক হোক, অর্থনৈতিক হোক, বিষয়টি আসলে লড়াইয়ের। সে লড়াইয়ে অংশগ্রহণের চরিত্র এমন হওয়ার কথা নয়। যুক্তি তা মানে না।

বৈশাখী নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠান সন্দেহ নেই জাতীয় চরিত্রের। এমন দাবিও আমরা করে থাকি যে একে জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। দাবিটা আমাদের শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনস্ক এলিট শ্রেণির, যা প্রায়ই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রবন্ধে-নিবন্ধে প্রকাশ পায়। তাতে আবেগের প্রকাশ প্রচুর। এর প্রেক্ষাপট রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈশাখী নববর্ষের মহোৎসব। এতে যুক্তি আছে।

কিন্তু বিপরীত যুক্তিও কম শক্তিমান নয়। ‘জাতীয়’ শব্দটি সর্বজনীন চরিত্রের, সমগ্র ভাষিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিফলন, তা শ্রেণি বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু এর আগের আলোচনায় গ্রামীণ বনাম রাজধানীকেন্দ্রিক নাগরিক নববর্ষের যে চরিত্রভেদ প্রকাশ পেয়েছে, বিশেষত উদ্যাপনে, তাতে একে সর্বজনীন চরিত্রের জাতীয় উৎসব বলা কঠিন।

স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজে অতি দ্রুত যে অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে শক্তিমান এক বিত্তবান ও পুঁজিবাদী শ্রেণির, দুর্নীতি ও অনৈতিকতা যে উত্থানের প্রধান উঁচুকেতার সিঁড়ি, তাতে অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রেণিবৈষম্যের ব্যাপক প্রভাব ও প্রতিফলন স্পষ্ট। পাকিস্তানি আমলের বাইশ পরিবার স্বাধীন বাংলাদেশে দ্রুতই এর বহুগুণ সংখ্যায় পরিণত। সমাজে এদের প্রবল প্রতাপ ও প্রভাব, যদিও বিশ্ববিচারের পরিসংখ্যানে এদের বলা হয় ১ শতাংশ।

শতাংশ বিচারেও এ সংখ্যা এক বা দুই যা-ই হোক, বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে এরা অবশিষ্ট শতাংশ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত অর্থনৈতিকভাবে। এর প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভুবনে, যেমন বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে একই চরিত্রে। তাই অনাচার, অনৈতিকতা বাংলাদেশি সমাজে ক্রমেই ব্যাপক চরিত্রে দেখা দিতে শুরু করেছে।

আর বৈশাখী নববর্ষ? তাতে দুর্নীতির কোনো সুযোগ না থাকলেও এর সাংস্কৃতিক চরিত্রেও শ্রেণিস্বার্থের প্রতিফলনই প্রধান, সেখানে নিম্নবর্গীয়দের অনুপস্থিতিই সত্য। এখানেই গ্রামীণ বৈশাখী নববর্ষ উৎসবের সঙ্গে মহানাগরিক নববর্ষের চরিত্রগত পার্থক্য। পার্থক্যটি শ্রেণিগত। তবে প্রসঙ্গত, এ কথাও সত্য যে গ্রামীণ নববর্ষও এখন তার আগেকার জমজমাট চরিত্রে নেই। শ্রমেরও পরিবর্তন ঘটে গেছে শাসনব্যবস্থার কল্যাণে। আর সে পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে লৌকিক সংস্কৃতিতে, গ্রামীণ নববর্ষ উদ্যাপনে। (কালের কণ্ঠের সৌজন্যে)

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত