
সুরেশ কুমার দাশ, ১৪ এপ্রিল, এবিনিউজ : বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এক মহাকাব্যিক ইতিহাস। কিন্তু বেশিরভাগ জানাতো দূরের কথা এর ছিটেফোটাও আমরা জানি না। অথচ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মৌলিক বিষয়গুলো জানা দরকার ছিল। অথবা ইতিহাস পাঠের পদ্ধতি জানা থাকা দরকার ছিল। এই কথা বলার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ কেন পাকিস্তানের শোষণমুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছে তার কথা বলতে গিয়ে। বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মুহাম্মদ হামিদুর রহমান যাদের পৈত্রিক নিবাস ছিল ভারতের কলকাতায়। ১৯৫৬ সালে তার বাবা আব্বাস আলী মন্ডল হামিদুর রহমানের জন্মের তিন বছর পর বাংলাদেশের বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে এসে আবাস পাতে। ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে এসেছিল তারা পাকিস্তানকে ভালোবেসেই। কলকাতা থেকে বাংলায় আসা এক তরুণ এমন কি রোষাণল অনুভব করলেন যে তাকে দ্রুত ভালোবাসার দেশ পাকিস্তানের শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ১৯৭০ সালে হামিদুর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৬/১৭ বছর জীবনে একজন পাকিস্তানি তরুণ এমন কি দেখলেন তাকে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যোগ দিতে হল। কতটা দ্রোহ আর সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করলে তিনি প্রাণ বিসর্জন দিয়ে প্রমাণ করতে সমর্থ হন পাকিস্তানের পৈশাচিকতার ভয়াবহতা। সুতরাং যে পাকিস্তানকে ১৮ বছরের একজন তরুণের সহ্য হয়নি, তেমনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ক্ষোভের আগুনে ছাই হবে– তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। তাদের দরকার ছিল একটি মাত্র আহ্বান। সেই আহ্বান তারা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের তৈরি করেছিলেন যাদুমন্ত্রে।
ইতিহাসের এমন মোক্ষম চিত্র তুলে এনেছেন ‘আমাদের গৌরব: সাত বীর শ্রেষ্ঠ’ গ্রন্থের লেখক মো. লোকমানুল আলম।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সি আবদুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান এই ৭ বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বগাথাকে তিনি তুলে এনেছেন অত্যন্ত আন্তরিকতায়।
লেখক বলেছেন, এই লেখাগুলো ৭ বীরশ্রেষ্ঠ সম্পর্কে বেশি বা নতুন কোনো তথ্য নয়, বরং মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের যে সমস্ত অকুতোভয় বীর সৈনিকরা বীরত্বপূর্ণ অসামান্য ও অতুলনীয় সাহসিকতার সাথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের জীবন গাথা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়া আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। তাঁদের স্মৃতি রক্ষা এবং তাঁদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান জানানোর লক্ষে দেশের রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা সদর এমনকি উপজেলা পর্যায়ের স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় বীরদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া জরুরি। এজন্যই এসব বীরদের বীরত্বের কথা তুলে ধরতে তিনি প্রয়াস নিয়েছেন। দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির জন্য জাতীয় বীরদের সম্পর্কে তাদের গৌরব ও বীরত্বগাথা সম্পর্কে প্রত্যেকের জানা উচিত।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমাদের জানা থাকলেও, মনে নেই হামিদুর রহমান মাত্র ১৮ বছরে শহীদ হয়েছেন। যিনি বীরশ্রেষ্ঠ। এটা একটা জাতির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিস্ময়। শহীদ হবার পরও তিনি তার বীরত্ব ও যুদ্ধ কৌশলের জন্য ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পান। পাকিস্তান সরকারের সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার সময় মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের অবহেলা ও নিপীড়ন, নির্যাতন, বৈষম্য দেখেই তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস পান। তবে, এসব ৭ বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে রুহুল আমিনকে হত্যা করেছিল রাজাকাররা। এটা হয়ত আমাদের অনেকের জানা নেই। ‘শত্রুর আক্রমণে বিএনএস পলাশ অল্প পানিতে কাত হয়ে গেলে রুহুল আমিন রূপসা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু তীরে উঠবার সাথে সাথে পিছন দিক থেকে একদল রাজাকার ক্রমাগত গুলিবর্ষণ করতে থাকে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অমানুসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে রাজাকাররা তাকে হত্যা করে রূপসার পাড়ে।’ এই তথ্য আমাদের কাছে অত্যন্ত বিস্ময়ের। ঘরবাড়ি লুট, অগ্নি সংযোগ, বাঙালি নারীদের সম্ভ্রমহানি, হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়াও রাজাকাররা কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেনি বরং এরমধ্যে আমরা জানলাম রুহুল আমিনের মত একজন বীরশ্রেষ্ঠকে প্রাণ দিতে হয়েছে রাজাকারের হাতে। এসব ঘটনা ঘটে ১০ ডিসেম্বরেই। আর ১৪ ডিসেম্বর শত্রুবাহিনীর হাতে প্রাণ বিসর্জন দেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। শেষ যুদ্ধে এই বৈমানিক পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিলেন। এসময় তার কপালে গুলি লেগে তিনি প্রাণ বিসর্জন দেন।
চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রকাশনী সংস্থা ‘শৈলী’ প্রকাশন মো. লোকমানুল আলমের লেখা ‘আমাদের গৌরব সাত বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রকাশ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় ও অসামান্য অবদানের জন্য যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এর সাহসিকতা ও বীরত্বের কথা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিকের কাজ করেছেন। প্রকাশনী সংস্থার কুশীলবদের মননশীল ও নান্দনিক উদারতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় বইয়ের আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এবং অঙ্গসজ্জার দিকে তাকালে।
মো. লোকমানুল আলমের লেখক সত্তা পূর্ণতা পেয়েছে অনেক আগে। এটা সম্ভব হয়েছে তিনি দীর্ঘজীবন অতিবাহিত করেছেন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থেকে। জীবনের অভিজ্ঞতার বাইরে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তার জীবনকে করেছে ধন্য। ভারত থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহের দায়িত্ব পান মাস্টার ইউসুফ আহমদের অনুপ্রেরণায়। মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে শেল্টারে পৌঁছানো, খাদ্যের যোগান দেয়া, খবরাখবর সংগ্রহ সহ নানা ভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যখন তিনি সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি যুক্ত হন লেখালেখিতে। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় দৈনিকে তিনি ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। বেতারের আলোকপাত অনুষ্ঠানেও তিনি লেখক ও পাঠক হিসাবে যুক্ত হন।
সুতরাং একজন লেখক যখন ভাবেন একটি বিষয় নিয়ে তার লেখা দরকার, সেটা তার চিন্তার একটা পরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সেদিক থেকে মো. লোকমানুল আলমের বইটি ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে ইতিহাস জানার জন্য সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বই, সংগ্রহে রাখার মত। যেখানে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠকে তিনি গ্রন্থিত করেছেন। নতুন প্রজন্মের মাঝে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এর বীরত্ব গাথা ছড়িয়ে দেয়ার এই মহতি উদ্যোগের জন্য লেখক অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। (সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি