
অজয় দাশগুপ্ত, ২০ এপ্রিল, এবিনিউজ : প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করার ভেতর আনন্দ খুঁজে নেয়া মানুষেরা সবসময় এটা করেন। তারা দেশের যেকোন ইস্যুকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে ভালোবাসেন। এদের আমরা চিনি। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখিনি। কোটা আন্দোলনের নামে যা হলো তার সারমর্ম বোঝা কঠিন কিছুনা। ছাত্র ছাত্রীরা কোমলমতি তাদের মনে যে রাগ দুঃখ বা চাওয়া তার প্রতিফলন ছিলো এই আন্দোলনে। তারা নিশ্চিত ভাবে সুগঠিত ভবিষ্যত চায়। এমন দিনও ছিলো যখন চাকরী হইলো সোনার হরিণ। সেই হরিণ ব্যতীত বাঁচাও সম্ভব ছিলোনা। আজ সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে দেশে। চাকরির জন্য সেই হাহাকার থিতিয়ে এসেছে তবে ফুরিয়ে যায়নি। যখন আমরা যৌবনের শেষপ্রান্তে তখন এসেছিলো প্রাইভেট বা বহুজাতিক কোম্পানীর জোয়ার। সেই জোয়ারে প্রাইভেট ব্যাংক আর এনজিওর চাকরী ছিলো লোভনীয়। এরপর শতশত কোম্পানী আর মিডিয়ার যুগে ছেলেমেয়েরা ছুটলো সেদিকে। সেগুলোতে না আছে কোটা না কোন আবদারের জায়গা। সরকারী চাকরীতে কোটা থাকার পেছনে যে কারণ সেগুলো ভুলেই আন্দোলনের নামে যে সব কাণ্ড তাতে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের দাবী দাওয়া বড় না হয়ে বড় হয়ে উঠলো রাজনৈতিক এজেন্ডা।
দেশে কোন ইস্যুটা স্বাভাবিক? মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কথা থাকতেই পারে। একথা বলিনা সেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নাই। আছে এবং থাকবে। কিন্তু সে ইস্যুকে সমাধান করার পরিবর্তে এমন এক বৈরী পরিবেশ তৈরী করা হলো যেখানে নারীর পা কাটা আরেকজনকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রায় বিবস্ত্র করার মত ঘটনায় কি স্বাভাবিকতা ছিলো আসলে? উপাচার্য কি কোটা দেন? না এগুলো তাঁর কাজ? এসব জানার পরও তাঁর বাড়ীতে হামলার কারণ কি? এগুলো আমরা সবাই জানি। খেয়াল করবেন এর মাধ্যমে রাস্তায় নেমে আসা যুবকের টি সার্টে আমি রাজাকার লিখে দেয়া হয়েছে। যেন রাজাকার হতে পারাটা আজ গৌরবের। কী সাংঘাতিক।
এর পেছনে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শাস্তি এবং তাদের কোণঠাসা হবার ঘটনা নেই? নেই খালেদা জিয়া কারাগারে থাকার যন্ত্রণা? যদি নাই থাকে বিলেত থেকে ইন্ধনের দরকার কি? মূলত ঐ যে বললাম এসবের একটাই উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে দুর্বল করা। মজার ব্যাপার এই এসব আন্দোলন বা ইন্ধনের পেছনে ছিলেন সুশীলেরা। আছেন দেশের রাজনৈতিক নেতারা। অথচ এদের কেউ কোনদিন ধর্ষণ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন করে উস্কে দেয়নি তারুণ্যকে। কারণ সেসব পাপে তাদের সবার ভাগ আছে, সায় আছে। প্রধানমন্ত্রী রাগে বা দুঃখে যে কারণেই হোক কোটা বাতিলের কথা বলেছেন। সেই বাতিল যদি আবার বিবেচনায় আসেতো ভালো না আসলেও বলবো, এমন কাজ করতে আপনারাই তাঁকে বাধ্য করেছেন। যা আর যাই হোক এদেশের ইতিহাস ও ভবিষ্যতের জন্য ভালো হতে পারেনা।
শেখ হাসিনার কথা বাদ দিলে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকাও নিন্দনীয়। তাদের যে মেয়েটি লাঞ্ছিত হয়েছে তার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা রেখেই বলি, এই মেয়ে কি সত্যি এমন মারধর আর গুন্ডাগিরি করে চলতো? যদি তা হয় তো সংগঠন কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেনা? কেন এতদিন ধরে এসব চলার বা করার সুযোগ পেলো সে? এটা কারো একার কাজ হতে পারেনা। এসব ঝামেলা কিংবা এসব পেশী শক্তি আগে ছেলেদের বেলায় একচেটিয়া থাকলেও এখন আর নাই। এখন ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে এগুলো একাকার। এটাও ভয়ের। একদিকে আমাদের নৈতিক অধঃপতন আরেকদিকে এর ভেতর আছে ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা। আজ এরা সরকারী দল বলে এমন করছে কাল যে আসবে তার আচরণ যে আরো নির্মম হবেনা তার গ্যারান্টি কোথায়? বরং কি হতে পারে তার নমুনা তো আমরা দেখলামই। সম্ভ্রম বা লজ্জা নিয়েও চলা যাবে না একসময়। হাতেতালি দেয়া ছাত্র ছাত্রীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই হিংসা ও সহিংসতা একটি রোগ। যুগ যুগ ধরে তার ধারাবাহিকতা এবং পরাজয়ের গ্লানি দেখার পরও আমরা মানিনা।
ছাত্রছাত্রী তথা আম জনতার একাংশে যে রাগ এবং যে বেদনা সেটা বুঝতে না পারা সরকারী দলের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। তারা ভুলে যায় গদী বা পাওয়ার সবসময় থাকেনা। বলা হয় নদীর ঢেউ মানুষের যৌবন আর শক্তি বা পাওয়ার চিরকালের কিছুনা। সেটা মাথায় না রাখা রাজনীতি ভুগলেও মানতে চায়না। এই ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা বৃথা হয়েছে যেসব কারণে তার একটি মানুষের ভয়। ভয়টা এই তারা জানে কারা করছে কেন করছে। শুধু প্রশাসন বা গায়ের জোরে তা করা যায়না। নীরব সমর্থন আছে বলেই হচ্ছে। কিন্তু সে জায়গাটার পরিচর্যা কোথায়? কোথায় সবাইকে নিয়ে রাজনীতি? বাম ডান কোন দলই এখন আর কথা বলেনা। বললেও আমরা শুনতে পাইনা। অথচ একটা সময় ছিলো এমন কোন ঘটনা ঘটলে তার দুদিকে দুপ্রান্তে দুটি ধারা সমানে কাজ করে মানুষকে বুঝিয়ে দিতো কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। এখন তা হয়না হয়না বলেই যা হয় তার নাম অতি আবেগ বা মারামারি। এই বাস্তবতা ভয়াবহ।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই দলের দ্বন্দ্ব মানুষকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। অথচ রাজনীতি প্রবহমান। তাকে ছাড়া দেশ চলেনা। কোনদিকে যাচ্ছি বা যাবো সেটা আমজনতা ঠিক করতে পারেননা। তারা অনুসারী মাত্র। সেখানে আজ আদর্শ বা অনুকরণীয় বলে কিছু নাই। ছাত্র ছাত্রীদের ভরসার জায়গা যে মাষ্টারেরা তারাও অভিভাবকত্ব হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের দলকানা রোগ আর কোন একদিকে ঝুঁকে থাকার প্রবণতা এতটা মারাত্মক এখন আর তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও কাজ করে না। ভয়াবহ এসব কারণগুলো আমাদের সমাজ ও দেশকে আর্থিক ভাবে এগুতে দিলেও সামাজিকভাবে পঙ্গু করে তুলছে। যার নমুনা দেখলাম অগ্রসর ছাত্রছাত্রীদের আচরণে। এরা মাদ্রাসার কেউ ছিলোনা। অথচ আমরা কথায় কথায় তাদের দিকে আঙ্গুল তুলি। এরা সবাই ধনী বিত্তবান কিংবা মধ্যবিত্তের ছেলে মেয়ে। অথচ কোথাও গিয়ে উগ্র আর অমানবিক। এ জন্যে তারা যতটা দায়ী তারচেয়ে অনেক বেশী দায়ী সমাজ ও রাজনীতি। তবু এটা মানতে হবে তাদের অন্তর এখনো পবিত্র আর নির্মল বলেই ঘটনা বেশীদূর এগুতে পারেনি।
তাই শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তিনি জননী বলে সেরাত ঘুমাতে পারেননি। পারেননি বলেই কঠিন হয়েছেন। একবার ভাবুন তিনি যদি গোঁ ধরতেন কি হতো? যারা বলে এটা নতজানু হওয়া তারা এটাও জানে অনেকসময় সমঝোতা ও ছাড় দেয়াও অগ্রসরতার প্রমাণ। সেদিক থেকে সরকার প্রধান ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা তিনি ঠিক কাজ করেছেন।আমার ধারণা হঠাৎ জ্বলে ওঠা দাবানল থামাতে এটাই ছিলো জরুরি। যদি আমরা তাঁর অতীত ও বর্তমানের কাজগুলো বিবেচনায় রাখি মানতে হবে তিনি দমে যাবার কেউ নন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বা ইতিহাস ও দমে থাকার কিছুনা। যারা আপাতত শান্তি পেলেন তাদের একটাই অশান্তি শেখ হাসিনার টিকি স্পর্শ করতে পারেননি। যতদিন তারা তা না পারবেন ততদিনই মঙ্গল। কারণ দেশ ও সমাজকে পুরো উল্টে দেয়ার রাজনীতি আসলে রাজাকরেরা কি করবে সেটা একটু হলেও দেখা গেছে। সাধু সাবধান।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামলেখক
(সংগৃহীত)