
বিকাশ চৌধুর বড়ুয়া, ২১ এপ্রিল, এবিনিউজ : ঠিক করেছিলাম এবারের সংখ্যায় লিখবো হল্যান্ডে পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়ে– কী সাজে সজ্জিত হয়ে এদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা বিশেষ করে রমণীরা চোখ ধাঁধানো বর্ণিল পোশাক গায়ে চড়িয়ে, চুলের গোছায় গন্ধহীন ফুলের মালা জড়িয়ে, সেজেগুঁজে এসেছিল বাংলাদেশ হাউজে, নাচে–গানে ভরিয়ে রেখেছিল আগতরা। প্রাণের স্পন্দন বয়ে গিয়েছিল সেদিনের গোটা অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ থেকে আসা এই প্রজন্মের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী সন্দীপন ও হৈমন্তী তাদের গানের মধ্য দিয়ে দিনটিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। দুজনেই আমার কাছে নতুন, পরে জেনেছি ’মধু কই কই আরে বিষ খাবাইলা’ গানটি গেয়ে সন্দীপন ইতোমধ্যে দেশে–বিদেশে (প্রবাসী বাংলাদেশি) ‘হিট’ শিল্পী। প্রবাসে যে সমস্ত দেশে ‘কেঁচকি’ মাছের মত বাংলাদেশীদের ঝাঁক সেখানে ছুটে যান তারা তারা, তাদের দল। দুজনেই চট্টগ্রামের শিল্পী, সে জন্যে আলাদা ভালো লাগা, যদিও বা তারা এখন আর কেউ চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে থাকেন না। পেশাগত কারণে ঢাকায় ঘাঁটি গেড়েছেন বলে পরে তাদের মুখ থেকেই শোনা। তাদের হল্যান্ডে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন হল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলালের স্ত্রী, ড. দিলরুবা নাসরিন। তিনি নিজেও শিল্পী, তার গান দিয়েই শুরু হয়েছিল ‘বাংলাদেশ হাউজে’ আয়োজিত সে দিনের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ হাউজ রাষ্ট্রদূতের সরকারি বাসভবন। কিন্তু এই সমস্ত বিশেষ দিনে গোটা হাউজটি (বাড়ীটি) আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশ হাউজে পরিণত হয়। খোলা থাকে তার সামনে–পেছনের দুটো দরোজা, সবার জন্য অবারিত, কোন বাধা নেই, যার যার প্রয়োজনে, কেউবা বিনা প্রয়োজনে, স্রেফ কৌতূহল চরিতার্থ করতে গিয়ে ঢু–মারে, ভেতরে ঢুকে, দেখে সুন্দর করে গোছানো ড্রয়িং রুমটিকে। সেদিনের অনুষ্ঠানে এক শিশু শিল্পী গেয়েছিল, (গানটি শুরুতে হলে আরো ভালো হতো বলে ধারণা) ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো / তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে / বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’, শিশুটি তার গানে বলেছিল বটে, ’বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’, কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে নিজেকে খুব দৈন্য মনে হলো যখন চোখে পড়লো, অতি সুন্দর, সবুজে মোড়ানো বড় উঠোনটি, যেখানে চমৎকার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে ফেলে রাখা সমস্ত আবর্জনা, দূতাবাস থেকে বিনে–পয়সায় দুপুরের যে খাবারের আয়োজন করেছিল, তার সমস্ত উচ্ছিষ্ট, এমন কি ’ওয়ান–টাইম’ প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস, টিস্যু যে যেখানে বসেছে, ঠিক সেখানে চেয়ারের নিচে বা পাশে, এদিক–ওদিক ছড়ানো–ছিটানো। ভাগ্যিস ততক্ষনে, তখন পড়ন্ত দুপুর, বিদেশী অতিথিরা বিদায় নিয়েছেন। তা না হলে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের সম্পর্কে একটা বাজে ধারণা নিয়ে যেতেন তারা। অথচ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ উচ্ছিষ্ট ফেলার জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে ব্যাগ রেখেছিল, এমন কী প্রবাসী বাংলাদেশীরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এই ধরণের আচরণ করবেন এই আশংকায় কয়েক স্থানে তারা নোটিশ টাঙিয়েছিল ‘নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা বা উচ্ছিষ্ট ফেলার জন্যে’। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো কে শোনে কার কথা। দূরের শহর থেকে এসেছিলেন এক বাংলাদেশি মহিলা, অনেকে তাকে ডাকে নিম্মি আপা বলে। মাঠে এদিক–ওদিক পড়ে থাকা ময়লা, উচ্ছিষ্ট, প্লেট দেখিয়ে বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে। জানতে ইচ্ছে করে যারা এমন গর্হিত কাজটি করেছে তারা কি তাদের বাসায় এমনটি করে’? ভদ্রমহিলার স্বামী বিদেশী, ডাচ। বললেন, ‘ভাগ্যিস তোমার দুলাভাই আসেন নাই, এই সব দেখলে খুব রাগ করতেন’। তিনি আরো বললেন, ‘আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মঞ্চে উঠে মাইক নিয়ে বলি, যার যার উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করুন’। এমনটি ফি বছরই হয়। বাংলাদেশে এমনটি হলে কিছু বলতাম না। কিন্তু এই সভ্য দেশে, এই সুন্দর দেশে এমনটি হলে কষ্ট হয় বৈকি। বৈশাখ আপাতত এইখানে থাক। পরে হয়তো কোন সময় আবারো কলম ধরবো এই নিয়ে।
বৈশাখের আনন্দের রেশ না কাটার আগেই মনটা বেদনায়, দুঃখে ভরে গেল। আবারো সড়ক দুর্ঘটনা দেশে। এ নতুন কিছু নয়, কিন্তু যেভাবে একটি তরতাজা ছাত্র অকালে প্রথমে তার একটি হাত হারালো এবং কদিনের মাথায় প্রাণটাও, তাকে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। মনটা তাই বেদনায় আচ্ছন্ন ছিল। মনটা আচ্ছন্ন ছিল রাজীবের হাত হারানো এবং হঠাৎ করে যেন আহত অভিমানে এই পৃথিবী থেকে তার বিদায় নেবার ঘটনা দেখে। রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্যের ছাত্র রাজীবের (২১) শোক কাটিযে উঠার আগেই কদিন আগে অনুরূপ সড়ক দুর্ঘটনায় আর এক তরুণ, হৃদয়ের (২০) হাত তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অনেকেই এই সমস্ত ঘটনাকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসাবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু এতো ‘দুর্ঘটনা’ নয়। ইংরেজিতে একটি কথা আছে– ’এক্সিডেন্ট কামস এক্সিডেন্টলি’, অর্থাৎ দুর্ঘটনা হঠাৎ করে আসে। কিন্তু যানবাহন বিশেষ করে ট্রাক, বাসের বেপরোয়াভাবে চালানোর কারণে এমনি কত ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন, দেশের বিভিন্ন স্থানে। গাড়ির চাপায় পড়ে, সামনে পেছনে দুই বাসের চাপে পড়ে এবং সম্প্রতি দুই বাসের পাশাপাশি সংঘর্ষে দুটি পৃথক ঘটনায় দুটি হাতের বিচ্ছিন্ন হবার ঘটনা, যার একটির পরিণতি করুণ মৃত্যুতে – নতুন বা কোন দুর্ঘটনা নয়। এগুলো নিয়মিত ঘটনা, ঘটছে অহরহ। দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি কারো বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা বা ভয় নেই বলে এমনটি হচ্ছে তা বলা বাহুল্য। ঘর থেকে বাইরে পা রাখলেই যেন সাধের প্রাণটিকে হাতে নিয়ে পথচলা। কখন যে প্রাণটি দ্রুতগতিতে এবং বেপরোয়াভাবে চলমান কোন গাড়ির ধাক্কায় উড়ে যাবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যদি প্রাণ নিয়ে ঘরে ফেরা হয় তাহলে ভাবতে হয় সৌভাগ্যবান। দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর তো কোন গ্যারান্টি নেই। এক্সিডেন্ট ঘটে চলে অহরহ। যত দুর্ঘটনা তত লাভ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, পুলিশের। তাতে বাড়তি আয় হয়। কেননা ‘কড়ি’ ফেললেই ‘ছাড়’ মেলে। আর ছাড় মেলে বলেই বাসের হেল্পার বসে চালকের আসনে, ফিটনেস ছাড়াই গাড়ি নামে রাস্তায়। পথচারীকে গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে কিছুদিন হাজতে থাকলেও এক সময় বেরিয়ে আসে অপরাধী চালক। তাকে আটকে রাখে সাধ্যি কার ! কারণ তার মালিক অতি ক্ষমতাধর। তিনি হয় রাজনীতিবিদ, নয়তো নেতার হাতা, কিংবা ক্ষমতাবান মন্ত্রী, পরিবহন মালিক বা শ্রমিকদের নেতা, বড়সড় ব্যবসায়ী, কিংবা মাস্তান, কিংবা প্রভাবশালী। তাদের ঠেকায় সাধ্য কার? দেশের প্রচলিত আইন? তাদের হাত তো আইনের হাতের চাইতে অনেক লম্বা। সাধারণ জনগণ তাদের কাছে জিম্মি, কোন প্রতিবাদ কোন ফল দেয় না। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে দেখেছি কী প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখিই না তাকে হতে হয়েছিল যখন তিনি ঢাকায় বাস–ট্রাক টার্মিনাল স্থানান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সাহসী ছিলেন বলেই তিনি কোন ধমক আর ভয়ের তোয়াক্কা করেননি। অনেকেই বলে তার পেছনের শক্তি ছিল বড় শক্তিমান, তাই উনি পেরেছেন।
কত লেখালেখি হয় এই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ আর সাংবাদিক মিশুক মুনির এমনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর কত না হৈ চৈ হলো, প্রতিবাদ হলো, মিছিল হলো, অপরাধীর শাস্তি দাবি করে কত প্রতিবাদ সভা করা হলো, হলো আন্দোলন। দেখেছি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী মারা যাবার পর চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে দেখেছি দিনের পর দিন এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে। তার গলা বসে গেছে চিল্লাতে চিল্লাতে। এক একটি দুর্ঘটনা ঘটে দেশে, সরব হয়ে উঠে দেশের অগণিত টিভি চ্যানেলগুলো। তারা তাদের টক শোয়ে ’টকের’ ঝড় তোলেন। কদিন ধরে চলে পত্র–পত্রিকায় এই নিয়ে সংবাদ, ব্যাখ্যা, পর্যালোচনা। প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন। তারপর সেই ‘যথা পূর্বং তথা পরং’, কে শোনে কার কথা। আবারো ঘটে ঘটনা (যা অনেকেই বলে দুর্ঘটনা), আবারো প্রাণ হারায় রাজীবের মত অনেকে। রাজীব মারা যাবার পর সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান ও রাজীবের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক, মো. শামসুজ্জামান বলেন, ‘আপনারা একটু লেখালেখি করেন। এমন মৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের, রাষ্ট্রের।’ রাষ্ট্রযন্ত্র কোথায়– কেবল ভাবি। কিছুটা আবেগাপ্লুত এই চিকিৎসক বলেন, ‘রাজীব নেই। আমরা খুব কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু রাজীবের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ত্রুটির কারণে এমন মৃত্যু, সেই ত্রুটিগুলো সারানো দরকার। আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হয়ে আসতেন। এখন এই সংখ্যা অনেক বেশি। এই যে আজ ভর্তি হয়েছে একটি বাচ্চা। জীবন বাঁচাতে তার পা কেটে ফেলতে হলো।’ কিন্তু কে শুনবে তার এই আবেগপূর্ণ, কষ্টে ভরা কথাগুলো। আমরা কি তবে আমাদের বিবেক হারিয়ে ফেলেছি? আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কি অর্থলিঞ্ঝুতার চাপায় অদৃশ্য হয়ে গেল?
এই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে গোটা বিশ্বে। উন্নত বিশ্বেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডব্লিউ এইচ ও–র এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি ২৫ সেকেন্ডে বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন যাত্রী বা পথচারী মারা যায়। ২০১০ সালে বিশ্বে প্রায় ২০ লক্ষ ২৫ হাজার মৃত্যু বরণ করে সড়ক দুর্ঘটনায়। ভাবতেই শিহরিত হতে হয়, এমনই ভয়ংকর এই সংখ্যা। বাংলাদেশে ফি বছর গড়ে ১২ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, পঙ্গু হয় প্রায় ৩৫ হাজার। বাংলাদেশের সড়ক বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ সড়ক হিসাবে পরিচিত। তবে সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে আমরা কি কেবল যানবাহন চলাচলে যে অব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দোষারূপ করে যাব? এর প্রতিকারে আমাদের অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কি কোন দায়িত্ব নেই? আমরা এই ব্যাপারে কতটুকু সজাগ সেই বিষয়টিও ভেবে দেখার বিষয়। আমরা কি সব সময় সড়ক বা যানবাহনের আইন মেনে চলি? যেখানে ফ্লাইওভার আছে সেখানেও কি আমরা দেখিনা পথচারী ফ্লাইওভার ব্যবহার না করে চলমান গাড়ির মাঝখানে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে? আমরা দোষ দেই চালকদের। গাড়ির মালিকদেরও দেখি অনেক ক্ষেত্রে চালককে উল্টোপথে গাড়ি চালাতে। সব কিছুর মূলে ‘দায়বদ্ধতা’, এই বিষয়টির বড় অভাব আমাদের দেশে। এই দায়বদ্ধতার অভাব বলেই অপরাধী পার পেয়ে যায়, অপরাধী শাস্তি পায় না, সাহস বাড়ে আর একটি অপরাধ ঘটাতে।
লেখক: প্রবাসী
(সংগৃহীত)