
ঢাকা, ২১ এপ্রিল, এবিনিউজ : বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষা, গণতন্ত্র উদ্ধার এবং গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠার জন্য সকলেই লড়াই চালাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে লড়াই চালাচ্ছে অর্জিত গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য। বিএনপির দাবি, আওয়ামী লীগ শাসনে দেশে গণতন্ত্র নেই। তারা গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য যুদ্ধরত। দেশে একটি সুশীল সমাজ আছে। তাদের চারুবাক সমাজও বলা চলে। তাদের কথা, দেশে আইনের শাসন, সুশাসন নেই। আর এ দুটি হলো গণতন্ত্রের ভিত্তি। সুতরাং তারা এই সুশাসনভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা চায়। সে জন্য তারা তাদের পছন্দের একটি অনির্বাচিত সরকার দ্বারাও একটা নির্দিষ্ট সময় দেশ পরিচালিত হোক- এটা কামনা করে। একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক সে জন্যই এক-এগারোর সরকারের নেপথ্যের সহযোগী ছিলেন। তারা এখনও বর্ণিত সুশীল সমাজের নিরপেক্ষতার ভেকধারী মুখপাত্র।
বাংলাদেশে এখনও তাই গণতন্ত্র মায়ামৃগ বা ছায়া হরিণ। সবাই বলছেন, তারা এই হরিণের পেছনে ছুটছেন। বাস্তবে তারা সবাই ছুটছেন নিজেদের ব্যক্তিগত, দলীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক কায়েমি স্বার্থ রক্ষার কাজে। গণতন্ত্র রক্ষা বা উদ্ধার এখানে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা কৌশলমাত্র। নইলে মায়াময় হরিণকে রেখে ছায়া হরিণের পেছনে তারা সকলে মিলে এমনভাবে ছুটতেন না। অতীতের ব্রিটিশ শাসকরা উপমহাদেশ শাসনের জন্য একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোর গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। প্রকৃত গণতন্ত্রের সঙ্গে এই গণতন্ত্রের পার্থক্য অনেক।
প্রকৃত গণতন্ত্রে নির্বাচিত পার্লামেন্টের সদস্যরা ও তাদের হয়ে মন্ত্রীরা দেশ পরিচালনার নীতিনির্ধারণ করেন এবং সরকারের বেতনভোগী আমলারা তা কার্যকর করেন। ঔপনিবেশিক গণতন্ত্রে আমলারা দেশ শাসনের নীতিনির্ধারণ করেন এবং মন্ত্রী-উপমন্ত্রীরা তা কার্যকর করার ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ তাকেই জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্ধারিত নীতি বলে চালান। দেশ শাসনে রাজনীতিবিদদের অনভিজ্ঞতাও অনেকটা অজ্ঞতার জন্যই এটা ঘটে। বর্তমান আওয়ামী লীগ শাসনামলেও এর যে ব্যতিক্রম ঘটেছে, তা নয়। তবে স্বৈরাচারী ও বিএনপি শাসনামলের চেয়ে আওয়ামী লীগ আমলে আমলাদের এই আধিপত্য একটু কম। কারণ, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। তার রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের এটা নেই। তার এক সময়ের ক্যান্টনমেন্টনির্ভর রাজনীতি সহসাই সম্পূর্ণভাবে আমলানির্ভর হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে সকলেই গণতন্ত্র চায়। এমনকি জামায়াতও চায়। যাদের দর্শন গণতন্ত্রবিরোধী, বিলাতে জামায়াতের বিভিন্ন সহযোগী দলের কোনো কোনোটি থেকে যে ইশতেহার প্রচার করা হয়, তাতে পশ্চিমা গণতন্ত্রকে বলা হয়েছে কুকরি গণতন্ত্র। অর্থাৎ কাফেরদের গণতন্ত্র। তাদের মতে, এই গণতন্ত্রের চর্চা করা ইসলামে না-জায়েজ বা অবৈধ। বাংলাদেশে জামায়াতের কণ্ঠেও এই গণতন্ত্রের দাবি শোনা যায়।
গণতন্ত্র শুধু চাইলেই হয় না। সামন্ত শক্তির সঙ্গে বহুকাল যুদ্ধ করে ইউরোপ যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তার ওয়েস্টমিনস্টার মডেল অনুকরণ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেই তা পারা যাবে না। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের মতো উন্নত নয়। সামন্তবাদ এবং ধর্মান্ধতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। আমাদের সমাজের উপরিভাগ পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে খুবই আধুনিক মনে হয়। কিন্তু ভেতরটা মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত। এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হলে আমাদের এলিট ক্লাসের একটা বড় অংশও তাতে বিশ্বাস করে।
উপমহাদেশের দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে বিদেশি শাসকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে। বিদেশি শাসকরা নামে দেশ শাসনে অনভিজ্ঞ রাজনীতিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন দেখালেও আসল ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছেন তাদের সৃষ্ট ঔপনিবেশিক আমলাদের হাতে। এই আমলারা কলোনিয়াল ডেমোক্রেসির পদ্ধতিতে (যে ব্যবস্থায় তাদের আধিপত্য) দেশ শাসনে অভিজ্ঞ ও আগ্রহী। জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা ঘোরবিরোধী।
নেহরু-ইন্দিরার শাসনকাল পর্যন্ত এই আমলাতন্ত্র প্রশাসনে খুব একটা দাঁত ফোটাতে পারেনি। কিন্তু রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই টেকনোক্র্যাট শাসনের ধুয়ার আড়ালে আমলাতন্ত্র তাদের আগের দাপট আবার ফিরে পায়। ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা তাদের গণবিরোধী শাসনের সুবিধার্থে কলোনিয়াল ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা পায়। আগে এই ডেমোক্রেসি ছিল বিদেশি শাসকদের অধীনে। এখন তা স্বদেশি শাসনের অধীনে। এই শাসনের মধ্যে খুব বড় একটা পার্থক্য নেই।
পাকিস্তানে কলোনিয়াল ডেমোক্রেসি কয়েক বছরও টিকতে পারেনি। একেই গণতন্ত্রবিরোধী ধর্মীয় স্লোগান দ্বারা রাষ্ট্রটি গঠন করা হয়েছে। তার ওপর জিন্নাহ গণতান্ত্রিক চরিত্রের নেতা ছিলেন না। তিনি তার চেয়েও শিক্ষিত এবং ব্যক্তিত্বশালী বাঙালি নেতা (জিন্নাহ ছিলেন ম্যাট্রিক পাস ব্যারিস্টার) ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো একসময় তাকে হটাতে পারেন- এই আশঙ্কা থেকে তিনি দু'জনকে শুধু মুসলিম লীগ থেকে তাড়াননি, পাকিস্তান হওয়ার পর রাষ্ট্র পরিচালনায় এই দুই অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাকে অংশগ্রহণ করতেও দেননি। প্রথম লিয়াকত মন্ত্রিসভায় সাবেক ও কর্মরত আমলাদের এনে শীর্ষ মন্ত্রী পদে বসান।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো শীর্ষ দুটি দপ্তরের দায়িত্বই চলে যায় ব্রিটিশ আমলের দুই আমলার হাতে। এ দু'জন হলেন গোলাম মোহাম্মদ ও স্যার জাফরুল্লা। জিন্নাহর মৃত্যু ও লিয়াকত হত্যার পর নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, তাতে ব্রিটিশ আমলের আমলা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে অর্থমন্ত্রী করা হয়। ব্যুরোক্র্যাট গোলাম মোহাম্মদকে করা হয় গভর্নর জেনারেল। অতঃপর চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে করা হয় প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় সিভিল ব্যুরোক্রেসির রাজত্ব। অবশ্য খোলসটা ছিল কলোনিয়াল ডেমোক্রেসির। এরপর মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। জিন্নাহ সাধের 'মুসলিম হোমল্যান্ডে' ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নামের আড়ালে প্রতিষ্ঠা পায় সামরিক ডিকটেটরশিপ।
ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে বিদেশি শাসকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনা দ্বারা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বিদেশি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই দ্বারা। এই যুদ্ধে জয়লাভ দ্বারা বঙ্গবন্ধু সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে মুসলিম জাতীয়তাবাদের বদলে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেন এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্র যোগ করে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনের স্বার্থে প্রথমেই কলোনিয়াল ডেমোক্রেসিতে হাত দেননি। কিন্তু ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরেই তিনি বুঝতে পারেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট এবং পাকিস্তানিমনা আমলাতন্ত্র দ্বারা তার স্বপ্নের সোনার বাংলা, সমাজতান্ত্রিক বাংলা গঠন করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যে '৭১-এর পরাজিত শক্তি দেশি-বিদেশি সাহায্যে পুনর্গঠিত হয়। এলিট ক্লাসের একটা বড় অংশ, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তারা যখন বুঝতে পারলেন, শেখ মুজিব জনগণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছেন, তাতে সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের যে সুবিধাভোগী অবস্থান তা বিপন্ন হবে; তখন তারা খুব দ্রুত একাট্টা হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এলিট ক্লাসের (তাদের অনেকেই আবার বিলাত-ফেরত) কাছে গণতন্ত্র বলতে কলোনিয়াল গণতন্ত্র। সেই মডেলেরই তারা প্রতিষ্ঠা চান। ওয়েস্টমিনস্টার ডেমোক্রেসির সঙ্গেও যে এই ডেমোক্রেসির পার্থক্য আছে, সেটা তারা হয় বুঝতে চাননি অথবা পারেননি। তারা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবকে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্তি করেন এবং এখনও করছেন।
বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উচ্ছেদের চক্রান্তে আমলাতন্ত্রের একটা বড় অংশ সহজেই যুক্ত হয়। কারণ তারা বুঝতে পেয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর নতুন শাসন ব্যবস্থায় তাদের ঔপনিবেশিক আমলের আধিপত্য লুপ্ত হবে। নব্য ধনীরাও এই চক্রান্তে যোগ দেন। কারণ, সমাজতন্ত্রী ধাঁচের অর্থনীতি প্রবর্তিত হলে অবাধ লুটপাট দ্বারা তাদের রাতারাতি বাঙালি আদমজী হওয়া সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে ধর্মহীনতা আখ্যা দিয়ে 'শেখ মুজিব দেশ থেকে ইসলাম উচ্ছেদ করছেন' ধুয়া তুলে পরাজিত মৌলবাদী শক্তি তার সরকারের উচ্ছেদ-চক্রান্তে জড়িত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত না করায় কিছুদিনের মধ্যে সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান-ফেরত সেনাপতিদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের অধিকাংশের মানসিকতা ছিল পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা দ্বারা গঠিত। পাকিস্তানের কায়দায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তারা শাসনক্ষমতা দখলের চেষ্টায় উৎসাহিত হন।
জেনারেল জিয়াউর রহমান যদিও ছিলেন হাফ মুক্তিযোদ্ধা (যুদ্ধের শেষ দিকে তাকে নিষ্ফ্ক্রিয় রাখা হয়েছিল); কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আগে ছিলেন পাকিস্তানের আর্মি ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের একজন জুনিয়র অফিসার। সেনা অফিসারদের চক্রান্তের পেছনে মদদ জোগায় পাকিস্তান ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার তদানীন্তন বৈরী শক্তি সৌদি আরব, চীন ও আমেরিকা। ফলে '৭৫ সালে প্রতিবিপ্লব ঘটানো সহজেই সম্ভব হয় সম্মিলিত ষড়যন্ত্র দ্বারা। দেশের বিভ্রান্ত বামপন্থিরাও এই চক্রান্তে মদদ জুগিয়েছে। এভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে জনগণতন্ত্র ধ্বংস করা হয়। সুশীল সমাজ ও তাদের মুখপত্রে একজন মিলিটারি শাসককে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলে গদগদ ভাষায় অভিনন্দন জানানো হয়। (শেষাংশ আগামী সপ্তাহে)। [দৈনিক সমকাল থেকে সংগৃহীত]
লন্ডন, ২০ এপ্রিল শুক্রবার, ২০১৮