![বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিগত সেবার ঋণাত্মক প্রভাব](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/27/bd-economy_137120.jpg)
প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য, ২৭ এপ্রিল, এবিনিউজ : ছোটবেলায় পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্য্য সম্পর্কে জেনেছি। এমন কি কর্মময় জীবনে প্রবেশের সময়ও সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কিত সপ্তম আশ্চর্য্য সম্পর্কে ধারণা রাখতে হয়েছিল। না জানি চাকুরীর পরীক্ষায় কোথায় এসে যায়। অথচ আজকের দুনিয়ায় আবিস্কৃত প্রায় বস্তুই আশ্চর্য্য। ১৯৭০ এর দশকে অধিকাংশ ধনী পরিবারেও রেডিও ছিল না। যেদিন প্রথম রেডিও শুনি সেদিন বন্ধুরা মিলে কতই না কল্পকাহিনী নিয়ে বাজে আলোচনা করেছি। তখন মাথায় এমন চিন্তাও এসেছিল যে, না জানি ঐ রেডিও নামক বাক্সটির ভিতর বসে কেউ গান গেয়ে চলেছে। আবার তাও সম্ভব বলে মনে হতো না। বায়বীয় তরঙ্গের ভিতর দিয়ে ওয়েভ যে ভেসে এসে উক্ত রেডিওতে ধরা দিচ্ছে তখন তা চিন্তা করার মত জ্ঞান যেমন ছিল না তেমনি পূর্ব ধারণাও ছিল না। যেদিন প্রথম টেলিভিশন দেখলাম সেদিন আরো আশ্চর্য্য হলাম। সাদা–কালো টিভির পর্দায় কি সুন্দর মানুষ পর্যন্ত দেখা যায়। অথচ কোন তার সংযোগ ছাড়া। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সংযোগ লাগিয়ে দিলেই বাংলাদেশ টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা যেত। এ সময় বন্ধুদের কেউ কেউ সিনেমার সাথে তুলনা করতো। কিন্তু তাদের যুক্তি ছিল সিনেমা হলে দর্শকদের পিছনে একটি উঁচু কক্ষ থেকে এক প্রকার লাইট ফেলে সিনেমা দেখানো হতো। কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় এরূপ লাইট ফেলার কোন সিষ্টেম নেই। যদিও টেলিভিশন নামক বস্তুটি সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি তবুও আমাদের কাছে সপ্তম আশ্চর্যের চেয়ে অধিক আশ্চর্য বলে মনে হতো, সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি তাঁর স্ত্রীর প্রতি ভালবেসে যে ‘তাজমহল’ গড়ে তুলেছে তা ছিল শ্রমসাধ্য এবং কারুকার্য্য বিশিষ্ট দুষ্প্রাপ্য হীরা, জহরত দিয়ে নির্মিত। যেহেতু সম্রাট শাহজাহান ছিল বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী সেহেতু তাজমহল গড়ে তোলার মত সামর্থ্য ছিল। তবে তাজমহলের কৌশলগত দিকটি ছিল অনন্য।
বিংশ শতাব্দীর সত্তর–এর দশকে টেলিভিশনে যখন কর্ডলেস স্পীকার দিয়ে গান করার ছবি দেখতাম তখন বন্ধুরা তা কখনো বিশ্বাস করতো না। আমরা মনে করতাম গায়ক শুধুমাত্র দেখানোর জন্য কর্ডলেস স্পীকারটি হাতে নিয়েছে। পরবর্তীতে যখন জানলাম এ কর্ডলেস স্পীকারের সাথে সাউন্ড বক্স–এর তারবিহীন সংযোগ রয়েছে তখন আমাদের কাছে এটিও একটি আশ্চর্য ঘটনা হিসেবে দেখা দিল। যদিও এ বিষয়গুলো সপ্ত আশ্চর্য্যের আওতায় পড়ে না। এর চেয়েও আশ্চর্যের বস্তু হলো মোবাইল ফোন। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে অবস্থানকৃত আত্মীয় স্বজন, বন্ধু–বান্ধব এর সাথে যোগাযোগ করা যায়। একসময়ে এরূপ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি। পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চিঠি পৌঁছাতে সময় লাগতো এক মাসেরও অধিক। কোন কোন সময় এ চিঠি হারিয়ে যেত। স্বামী–স্ত্রী, সন্তান ও বন্ধু–বান্ধব, আত্মীয়–স্বজনদের মধ্যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতো দীর্ঘসময় ব্যবধানে। অথচ আজ সে আবেগ প্রকাশ করা যায় কয়েক সেকেন্ডে। মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হয় ১৯৭৩ সালে। মোটোরোলা কোম্পানীতে কর্মরত ড. মার্টিন কুপার এবং জন ফ্রান্সিস মিচেল ব্যাপক গবেষণা করে প্রায় এক কেজি ওজনের একটি বস্তু আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এর পরবর্তীতে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অবশেষে ১৯৮৩ সালে ‘মোটোরোলা ডায়না টিএসি ৮০০০এক্স’ নামক ফোন বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে। কিন্তু প্রায় সাত বছর ফোনের কাঠামোগত কারণে মোবাইল ফোনকে জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব হয়নি। ১৯৯০ সাল থেকে মোবাইল ফোনের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রথম চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। ‘হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড’ নামক একটি কোম্পানী ঢাকা শহরে ইুওে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা চালু করে। পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন কোম্পানী মোবাইল সেবা চালু করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এখন যে কোন মানুষের জন্য এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
মোবাইল সেবা এ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে বেশি। অর্থনীতিতে জাতীয় আয়কে হিসাব করার জন্য বিভিন্ন উৎপাদনশীল ব্যবস্থাগুলোকে বেশকিছু খাতে ভাগ করা হয়েছে। যেমনণ্ড কৃষি খাত, শিল্প খাত, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত, সেবা খাত ইত্যাদি। মোবাইল সেবা থেকে প্রাপ্ত আয় সেবা খাতকে প্রসারিত করেছে অধিক। ফলে সামগ্রিক হিসাবে বাংলাদেশের লোকদের মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে মোবাইল সেবা তথা সেবা খাতের অবদান অধিক। শুধু তাই নয়, এ দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও সেবা খাতের তথা মোবাইল সেবার অবদান রয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে মোবাইল কোম্পানীগুলো। আধুনিক ইন্টারনেট সহায়তার সুবিধা নিয়ে এদেশের গ্রামাঞ্চলেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের যে কোন তথ্য অতি দ্রুত জানার জন্য ইন্টারনেটের তথা তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছে। লেখাপড়া, গবেষণা, হিসাব–নিকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এ কাজে পর্যাপ্ত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানীগুলো।
বাংলাদেশের জনগণ মোবাইল, ইন্টারনেট, তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে যত সচেতন মোবাইলের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে তেমন সচেতন নয়। প্রত্যেক মোবাইল কোম্পানী মোবাইলের নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করার জন্য যত চিন্তা করে মোবাইলের বা মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন নিয়ে তত চিন্তা করে না। মোবাইল নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করার জন্য প্রত্যেক মোবাইল কোম্পানী প্রতিটি এলাকায় মোবাইল টাওয়ার তৈরি করে। মোবাইল টাওয়ার থেকে ঋুৗ (ইলেকট্রিক ম্যাগনেট রেডিয়েশন) এর ভিতর দিয়ে মোবাইলে সংযোগ তৈরি হয়। কিন্তু মোবাইল টাওয়ার থেকে ক্রমাগত নির্গত হতে থাকে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ঘটিত ‘ইলেক্ট্রো স্মোগ’– যা মানুষের বায়োলজিক্যাল সিষ্টেম, পশু, পাখি, পোকামাকড়, গাছের ফল ইত্যাদির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের উপর সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ৯১৯টি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। তৎমধ্যে ৫৯৩টি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত ‘ইলেক্ট্রো স্মোগ’ পশু, পাখি, পোকামাকড়, অনুজীব এবং মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মোবাইল কোম্পানীগুলো টাওয়ার স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি নীতি অনুসরণের কথা ছিল। এ নীতিটি হয়– প্রতিটি মোবাইল টাওয়ার আবাসিক ভবন থেকে সর্বনিম্ন ৩০০ মিটার দূরে নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু মোবাইল কোম্পানীগুলো সেই নিয়ম মানছে না। এক জরিপে দেখা গেছে মোবাইল টাওয়ারের ইলেকট্রিক ম্যাগনেট রেডিয়েশন ঋুৗ এর প্রভাবে সেন্টমার্টিনে নারিকেল গাছের ডাব উৎপাদন কমে যাওয়া, মরে যাওয়া, আকারে ছোট হওয়াসহ অকালে অনেক গাছ মারা যাচ্ছে। তাছাড়া ইলেকট্রিক ম্যাগনেট রেডিয়েশনের কারণে জেনেটিক পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারের পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে অটিজমে (মানসিক প্রতিবন্ধী) আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ছিল একজন, ২০০৩ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ জনে।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতির এ দেশে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের বিরূপ প্রভাবে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবন ও জীবিকায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। মাটি দূষণ, পানি দূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দ দূষণের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে ইলেকট্রিক ম্যাগনেট রেডিয়েশন (ঋুৗ)। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আবাসিক এলাকা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে অনেক দূরে এবং অনেক উঁচুতে মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়। অথচ বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ৯০ শতাংশ টাওয়ার লোকালয়, বাড়ি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খুব কাছাকাছি অথবা এসব এলাকার ছাদের উপর স্থাপন করা হয়েছে। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নীতি অনুসারে বর্তমানে অবস্থিত টাওয়ারের ১ কিঃমিঃ এর মধ্যে নতুন কোন টাওয়ার নির্মাণ করা যাবে না। প্রতিটি টাওয়ার ৮০ ফুট উচ্চতায় কমপক্ষে ১৯৯ ফুট উচু হতে হবে।
প্রিয় পাঠক, মোবাইল কোম্পানিগুলোর লাভের পরিমাণ যেন হ্রাস পায়, সে কথা যেমন আমি কখনো বলবো না তেমনি মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হোক– সে কথাও কখনো বলবো না। বিজ্ঞানের অগ্রগতি কখনো থামিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানবজাতিকে ধ্বংস করার উপক্রম হয়, লিউকেমিয়া, ক্যান্সারের মত রোগকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে, সে অগ্রগতিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে ঠিক রেখে কিভাবে মানবজাতির অধিকতর উপকার হয় সে পদ্ধতি বের করতে হবে। অন্যথায় বিজ্ঞান একদিন মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ নয় বরং অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ
(সংগৃহীত)