বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, ২৮ এপ্রিল, এবিনিউজ : মনেই ছিলনা আজ হাসপাতালে চোখের ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল। এপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে। দেশে যাবার সপ্তাহ দুয়েক আগে। ফিরে এসে নানা কাজের ভীড়ে সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম মাঝের এই কয়েক মাসে। আপনি ভুলে গেছেন ? নো প্রবলেম। মজার ব্যাপার হলো শারীরিক সমস্যা আপনার হলেও এদেশের ‘চিকিৎসা সেবা’ এমনই যে, মনে হবে সমস্যা হাসপাতালের, মাথাব্যথাও তাদের। আপনার মনে নেই, তাতে কী হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে চিঠি দিয়ে, কিংবা ই–মেইল পাঠিয়ে কিংবা মোবাইলে ক্ষুদে–বার্তা পাঠিয়ে যে ‘অমুক দিন অতটা বাজে অমুক ডাক্তারের সাথে আপনার এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা আছে’। এ শুধু চোখের ডাক্তারের বেলায় নয়, যে কোন শারীরিক সমস্যার
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ডায়াবেটিস থাকলে সেটিও তাদের মাথা ব্যথা। আপনাকে কয়েক মাস পর পর চিঠি বা বার্তা পাঠিয়ে মনে করিয়ে দেবে আপনার চেক–আপের সময় হয়ে এসেছে, আগেভাবে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিন ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশ থেকে ফিরেছি মার্চের প্রথম সপ্তাহে। ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি জেনেভা সম্মেলন নিয়ে। গত দু–মাসে দুবার যেতে হয়েছে সেখানে। ফলে মনে ছিল না আজ চোখের ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট ছিল। ওরাই মেইল পাঠিয়ে দিন কয়েক আগে মনে করিয়ে দিয়েছিল। এখানকার হাসপাতাল মানে ঝকঝকে, তকতকে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্থান। রিসেপশন দামী হোটেলের লবির মত। সেখানে রাখা অটোমেটিক মেশিনে আপনার পাসপোর্ট কিংবা আইডেন্টিটি কার্ড কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স ঢুকিয়ে দিলে ছোট স্ক্রীনে ভেসে উঠে আপনার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য। জানতে চায় সঠিক কিনা, সঠিক হলে হ্যাঁ–সূচক বোতামে টিপ্ দিন। তারপর বেরিয়ে আসে স্লিপ। আপনাকে সাহায্য করার জন্যে হাসপাতালের কয়েক কর্মী ধারে–কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা এগিয়ে আসবেন আপনার এই আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে কোন সমস্যা থাকলে। যাই হোক, যে স্লিপ পেলেন তাতে লেখা কোন জায়গায় যাবেন। সেখানে গিয়ে আর একটি মেশিন। তাতে আপনার হাতের স্লিপটি স্ক্যান করলে বলে দেবে, অমুক নম্বর দরোজার সামনে রাখা চেয়ারে আসন গ্রহণ করুন। আপনি অপেক্ষা করছেন, নির্দিষ্ট সময়ে আপনার নম্বর উঠে আসবে পর্দায়। সেই মোতাবেক নির্দিষ্ট দরোজা খুলে ডাক্তার সহাস্যে, হাত বাড়িয়ে আপনাকে তার চেম্বারে নিয়ে যাবেন। তারপর পরীক্ষা এবং যা যা করণীয় তা করবেন। আমাদের দেশে ভাবতে পারেন? ডাক্তার তার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে রোগীকে সহাস্যে ডেকে নিয়ে ভেতরে যাবেন, তেমনটি বাংলাদেশে কল্পনায়ও চিন্তা করতে পারিনে। অনেক ডাক্তার তো রোগীর সাথে ভালো ব্যবহার পর্যন্ত করতে পারেন না। এ সব এর–ওর কাছ থেকে শোনা এবং নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বলা।
অনেক দিন পর এই হাসপাতালে আসা। হাসপাতালে যত কম আসা যায় তত ভালো। নাম ‘হাগা ছিকেনহাউস’ অর্থাৎ হেগ হাসপাতাল। দেখলাম এর অনেক কিছু বদলে গেছে। ঢুকতেই হাতের বায়ে চমৎকার ক্যাফেটেরিয়া। তাতে আপনি টাকা দিয়ে খেতে পারেন চা–কফি থেকে শুরু করে অনেক কিছু। দামও সহনীয়। আজ নতুন যা চোখে পড়লো এবং ভালো লাগলো তা হলো, অপেক্ষা করছি ওয়েটিং রুমে, এমন সময় ট্রলি নিয়ে এক মহিলা কর্মী এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। সবার সামনে এসে জানতে চাইছেন চা–কফি খাবো কিনা। কেউ খেলেন, কেউ ‘না’ করলেন। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করতেই বলি, চা। দুধ, চিনি? বলি, না শুধু রং চা। ‘বেশ ভালো সার্ভিস দিচ্ছেন তো আপনারা ? এটি কি নতুন, জানতে চাই। মৃদু হেসে আধ–বয়েসী এই মহিলা বলেন, হ্যাঁ। প্রতিদিন বিনে পয়সায় এমন করে অপেক্ষমান রোগীদের বা তাদের সাথে যারা আসেন তাদের চা–কফি দেন? উত্তরে মহিলা বলেন, হ্যাঁ, প্রতিদিন দুই বেলা করে দেয়া হয়। ‘সেবার’ আর এক চমৎকার উদাহরণ। হেগ শহরের আর একটি বড় আকারের হাসপাতাল, নাম ওয়েস্টআইনডে ছিকেনহাউস। সেখানে আছে অটোমেটিক চা–কফির মেশিন। আপনি চাইলেই খেতে পারেন। বিনে পয়সায়। রোগী কিংবা রোগীর সাথে আসা এটেন্ডেন্ট–র হাসপাতালে এসে অপেক্ষা করতে গিয়ে যাতে কোন ধরণের অসুবিধে না হয় তার বিশেষ ব্যবস্থা।আপনার শারীরিক সমস্যার কারণে আপনি এসেছেন হাসপাতালে। আপনার নিজের সমস্যা, কিন্তু আপনাকে সেবা করার, ভালো করে তোলার সমস্ত দায়িত্ব যেন তাদের। একেই বলে “চিকিৎসা সেবা’’। আমার একটা সমস্যা হলো, প্রবাসে বা অন্য কোন দেশে গেলে, ভালো কিছু দেখলে মুহূর্তে দেশের কথা মনে পড়ে। আপনাতেই মনে মনে দেশের ছবি ভেসে উঠে, তুলনামূলক চিত্র এসে দাঁড়ায়। তখন কষ্ট হয়, ব্যথা লাগে। আর কেবল মনে হয়, আমরা কেন এত পিছিয়ে, আমরা কবে হবো এমনটি, আমরা কেন এদের মত হতে পারছিনা। এক ধরণের হতাশায় পেয়ে বসে। মনে হয় এমনটি হবে না আমাদের দেশে কখনো, এমনটি হবার নয়। তারপরও আশা উঁকি মারে, যেমনটি ঝড় শেষে সূর্যের আলো। তখন আশায় বাঁধি ঘর।
বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন সে আমাদের সবার কমবেশী জানা। আমাদের দেশে একটা কথা চালু আছে– ‘থানার কাছে কানা যায় না’। অর্থাৎ থানা জায়গাটি এমন একটা জায়গা যেখানে গেলে মানুষের সমস্যা বাড়ে বই কমে না। অন্ততঃ এই ধরণের একটি ধারণা সবার। অনেকে ডাক্তারকে কসাইর সাথে তুলনা করে। জানিনে কেন? কসাইরা কি ডাক্তারদের মত কসাই? কসাই তো পশুর গলা কাটে, কিন্তু ডাক্তাররা তো মানুষের। তারা রোগীর, রোগীর নিকটজনের কাছে গলা কাটার মত দাম হাঁকেন। হাসপাতাল বিশেষ করে বড় বড়, তথাকথিত আধুনিক, অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলির ক্ষেত্রে এমন একটি ধারণা ও চিত্র আমাদের সবার জানা। কেবল অর্থ লিঞ্ঝূতার কারণে এই সমস্ত বড় বড় হাসপাতালে বিনা কারণে ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে’ রোগীকে পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার সংবাদ আমরা প্রায় পত্র–পত্রিকায় দেখি। এ নিয়ে হাসপাতালগুলিতে রোগীদের অযথা হয়রানি, কষ্ট দেয়ার কাহিনী পড়ি পত্র– পত্রিকায়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে। চিকিৎসার মানের কথা আর নাই বা উল্লেখ করলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অসুস্থ বন্ধু, বিশিষ্ট সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বাসায় গিয়েছিলাম তাকে দেখতে। তার স্ত্রী আমার এক সময়কার সহকর্মী (ঢাকায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট) ঝর্না বলছিলেন তাকে (মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর) নিয়ে এক প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে তাদের কী অবর্ণনীয় হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল সে কাহিনী। এক পর্যায়ে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বড় ভাই, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করলে মুহূর্তে গোটা পরিস্থিতি বদলে যায়। তাদের বলা হলো, এই কথাটি আগে বলবেন তো? কী অবাক করা কথা ! অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম কেন বলতে হবে? আমার মতো লাখো সাধারণ নাগরিকের তো মুহাম্মদ ইউনূসের মত নামী–দামী ভাই নেই। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরেরও নিজের একটা পৃথক পরিচিতি আছে, অনেকেই তাকে চেনে। এই যদি হয় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মত সমাজে পরিচিতি থাকা ব্যক্তির এই ধরণের হয়রানি ও নাজেহাল, সে ক্ষেত্রে আমজনতার কী দশা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের বড় বড় ও নামকরা হাসপাতালগুলিতে যা চলছে তা হলো দেশের আর পাঁচ–দশটি ব্যবসার মত ‘চিকিৎসা ব্যবসা’ এবং মজার ব্যাপার হলো এই ব্যবসাটি বেশ রমরমা ব্যবসা। এই কথাটি বলে বছর দেড়েক আগে প্রলুব্ধ করতে চাইলেন আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু। ব্যবসায়ী এই বন্ধুটি ঢাকায় তাদের নির্মাণাধীন অত্যাধুনিক হাসপাতালের শেয়ার হোল্ডার হবার জন্য প্রস্তাব রাখেন। বললেন, এক কোটি টাকা দিয়ে শেয়ার হোল্ডার এবং ডিরেক্টর হোন, এটি খুব লাভজনক প্রজেক্ট। অংক কষে আমাকে দেখালেন বছরে কী পরিমান রিটার্ন আসবে এবং কত লাভ হবে। কিন্তু তার দীর্ঘ ব্যাখ্যার কোথাও তিনি একবার ভুলেও উল্লেখ করলেন না যে ব্যবসার পাশাপাশি তারা জনগণের সেবাও করবেন বা সেবা দেবেন। আমাদের সমাজে প্রায় সবার মাঝে প্রয়োজনের বাইরেও অর্থ উপার্জন করার প্রতিযোগিতা দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষ্যণীয়– সে বৈধ বা অবৈধ পথে কিংবা অন্যকে ঠকিয়ে হলেও। বিষাক্ত সাপের ফণার মত লিক লিক করে বেড়ে গেছে আমাদের এই অর্থলিঞ্ঝূতা। কেবল চিকিৎসা ক্ষেত্রে নয়, জীবনের, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। জনগণ জিম্মি হয়ে আছে সব ক্ষেত্রে। রোগ শোক হলে হাসপাতালের মুখোমুখি হতেই হবে, সে আপনি চান আর নাই চান। কেননা উপরওয়ালার পর তো ডাক্তার, যার দোরগোড়ায় আপনাকে হাজির হতে হবে। ডাক্তাররা সেটি জানেন, আর জানেন বলে, তারা আবারো বলি, হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এই ‘মোক্ষম’ মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকেন। তারপরও আমি আশাবাদী। সে কথা একটু আগেও উল্লেখ করেছি। আশা করবো এর পরিবর্তন হবে। ডাক্তাররা কেবল ‘মানী মেকিং মেশিন’ হবেন না, তারা একটু মানবিক হবেন। মহৎ এই পেশা চিকিৎসাকে কেবল ‘ব্যবসা’ হিসাবে না নিয়ে ‘সেবা’ হিসাবেও নেবেন – এই আশা রেখে শেষ করছি আজকের এই লেখা।
লেখক: প্রবাসী
(সংগৃহীত)