![মে দিবস ও ন্যূনতম মজুরি : আনু মুহাম্মদ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/05/01/moktomot_137626.jpg)
ঢাকা, ০১ মে, এবিনিউজ : ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের অধিকার এখন বিশ্বে এমনভাবে স্বীকৃত যে, তাকে স্বতঃসিদ্ধ বলেই মনে হয়। কিন্তু এ অধিকার মানুষ এমনি এমনি পায়নি। তার জন্য অসংখ্য মানুষের শ্রম ঘাম মেধা কাজ করেছে, অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। যে ঘটনাপ্রবাহ উনিশ শতকে মে দিবস তৈরি করেছিল, তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল তত্কালীন বাস্তবতায়। সেকালের অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা এবং কর্মক্ষেত্রে শিশু-নারীসহ শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা ও নির্যাতন দূর করার জন্য কয়েক দশকে মানুষের চিন্তা, সক্রিয়তা ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগঠন ও আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। কাজের সময় কিংবা মজুরির তখন ঠিক ছিল না। ক্রমেই নারী-শিশুসহ শ্রমিকদের অবর্ণনীয় জীবন পরিবর্তনের জন্য অসংখ্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ তৈরি হয়। সংগঠন গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তা ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকারের দাবিতে একটি ব্যাপক ঐকমত্য তৈরি করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিনে তিন লক্ষাধিক শ্রমিকের ধর্মঘটের মধ্যে অন্য অনেক শহরের মতো শিকাগো শহরেও বড় সমাবেশ হয়। আতঙ্কে হামলা করে রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ। প্রতিবাদে আবারো সমাবেশ, আবার হামলা। গুলিতে সংঘর্ষে শ্রমিক নিহত হন, পুলিশও। পরে প্রহসনমূলক বিচারে সংগঠকদের ফাঁসি দেয়া হয়।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের প্রবল তত্পরতায় এ দিবসই ক্রমে প্রতীক হয়ে ওঠে। বিশ্বের প্রায় সব দেশে দিবসটি এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও এ দিবস পালন করছে নিয়মিত। অবশ্য যে দেশে ‘মে দিবসের’ জন্ম, সেই যুক্তরাষ্ট্রে এ দিবস ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টায় মে দিবস পালিত হয় না, সেখানে সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় শ্রম দিবস।
এত বছর পরও ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নেহাত টিকে থাকতেও শুধু ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই হয় না, শিশুসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজে যোগ দিতে হয়। এছাড়া মজুরিবিহীন শ্রমের অস্তিত্ব আছে, আছে নারীর অস্বীকৃত শ্রম। আইএলও কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলেও সে কনভেনশনে স্বীকৃত শ্রমিকদের বহু অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ নন, যারা শ্রমিক বলে নিজেদের ভাবেন না— এ রকম পেশাজীবীরাও এখন পরিবারের একাধিক সদস্যের রোজগার ছাড়া জীবন চালাতে পারেন না। কিন্তু তা হওয়ার কথা নয়। একজনের আয়ে অন্তত চারজনের পরিবার বাঁচার মতো আয় করতে পারবেন— সেটাই স্বীকৃত অধিকার।
বর্তমানে দেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। শ্রমিকদের মধ্যে খাতওয়ারি কিছু ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, সব প্রতিষ্ঠানে তাও কার্যকর হয়নি। জাতীয় ন্যূনতম মজুরির অনুপস্থিতি, চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি থাকা এবং অসংগঠিত খাতের প্রাধান্যের কারণে সব পর্যায়ে মজুরি ও বেতনের ক্ষেত্রে সবসময়ই একটি নিম্নমুখী ঝোঁক বা টান থাকছে। ক্ষুদ্রশিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং অনানুষ্ঠানিক খাত যেখানে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান হচ্ছে, সেখানে কোনো মজুরিবিধি নেই, সরকারেরও সেক্ষেত্রে কোনো দায়দায়িত্ব বা ভূমিকা দেখা যায় না। দেশে শিশুশ্রমিকদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য, যাদের অনেকক্ষেত্রে কোনো মজুরিই থাকে না, থাকলেও খুবই কম। আর শিশুশ্রমিকরাই, আর তাদের মধ্যে মেয়েরা আরো বেশি, সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে। নির্যাতন ও নিরাপত্তাহীনতার নানা ঘটনা কমই প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে দেশে শিল্প শ্রমিকদের একক বৃহৎ অংশ গার্মেন্ট শ্রমিক। গার্মেন্ট খাতে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন তো বটেই, এমনকি বকেয়া মজুরি, ওভারটাইম পরিশোধ, সংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার, বেআইনি ছাঁটাইবিরোধী আন্দোলন এখনো করতেই হচ্ছে। নির্যাতন, হুমকি, যৌন নিপীড়ন এসবও নানাভাবে জারি আছে। তাজরীনে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিক ছাই হওয়া, রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক জীবন্ত কবরস্থ হওয়ার ভয়ঙ্কর ঘটনা এ শিল্পের একদিকে দ্রুত বিস্তার, অন্যদিকে এর বিশালসংখ্যক শ্রমিকের অরক্ষিত অবস্থাই নির্দেশ করে। পাঁচ বছর পূর্তি হলেও ক্ষতিপূরণ, দায়ীদের বিচার ইত্যাদি অনিষ্পন্ন থাকায় বোঝা যায়, এত বড় ধসের পরও অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই, যা হয়েছে তা মূলত মুখের কথায় বা বাইরের চেহারায়। অনেক শিল্প উপখাতের শ্রমিকদের অবস্থা গার্মেন্ট শ্রমিকদের থেকেও খারাপ।
সরকারি পরিসংখ্যান এ রকম দাবি করতে চায়, ৪৫ বছর আগের তুলনায় কৃষি শিল্পসহ সব পর্যায়ের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বর্ণনামতে, ১৯৬৯-৭০ সালে মজুরি সূচক ১০০ ধরে বর্তমানে নামিক বা টাকার অংকে মজুরি সূচক দাঁড়ায় ৮০৯৭, টাকার অংকে বেড়েছে প্রায় ৮০ গুণ। তবে লক্ষ করতে হবে, একই সময়ে চলতি দামস্তরে জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৩০০ গুণ। সরকারি দলিলে, দেশের শ্রমিকদের গড় মজুরি ধরা হয়েছে মাসিক ৫ হাজার ৫৬২ টাকা। গড় এ মজুরি সঠিক তথ্যের কাছাকাছি হতে পারে, যদি সব শ্রমিকের মজুরি পরিশোধিত হয়, তাদের ১২ মাস কাজ থাকে এবং ১২ মাস কাজ করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু বাস্তবতা তার থেকে অনেক দূরে।
পরিসংখ্যানের ধরন থেকে এটা ধারণা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে, সরকারি প্রতিষ্ঠান মজুরির পরিবর্তন হিসাব করতে গিয়ে আগের প্রান্তের মজুরির কম দিকটা ধরেছেন এবং পরের প্রান্তের মজুরির ঊর্ধ্বসীমা ধরেছেন। ফলে প্রকৃত মজুরির যে বৃদ্ধি দেখা যায়, তা স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের মজুরিচিত্র ছাড়া বাকি অধিকাংশ ক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া সরকারি পরিসংখ্যানে অন্য বড় ঘাটতি হলো কর্মঘণ্টা বিবেচনায় না নেয়া। একজন মানুষ যদি কর্মঘণ্টা বৃদ্ধির মাধ্যমে তার মজুরি বৃদ্ধি করে, সেই বর্ধিত মজুরিকে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি হিসেবে অভিহিত করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কেননা প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী, ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি পাওয়ার কথা। অথচ বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ তা না পেয়ে কর্মসময় বৃদ্ধির মাধ্যমেই আর্থিক সংকট মোকাবেলা করছেন। অর্থাৎ তারা একাধিক কাজ, পরিবারের আরো সদস্যের কাজে যোগদান, বর্ধিত শ্রমসময় কিংবা বাড়তি আয়ের নানা রাস্তা খোঁজার মাধ্যমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। বিদ্যমান বাজারদর অনুযায়ী হিসাব করলে সরকার নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমায় পৌঁছতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতে চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক আয় হতে হয় কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা। তার মানে, সরকারের হিসাবে প্রাপ্ত গড় মজুরিও দারিদ্র্যসীমার আয়ের শতকরা ৫০ ভাগের নিচে। গার্মেন্টসে সর্বশেষ ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও তাই। মজুরি কীভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে হতে পারে এ প্রশ্ন খুবই জোরেসোরে তোলা দরকার।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের অবস্থান শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জাতীয় আয়ে তাঁদের অংশীদারিত্ব বাড়ল না কমল, সে প্রশ্নের উত্তর থেকে অর্থনীতির বিকাশের গতিমুখ চিহ্নিত করা সম্ভব। তিন দশক আগে সইফ উদ দাহার এ অংশীদারিত্বের অনুপাত হিসাব করে দেখিয়েছিলেন। বিশ্লেষণ থেকে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল, স্বাধীনতার পর জাতীয় আয়ে শ্রমিক শ্রেণী ও বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের অংশীদারিত্ব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ হিসাবটি আমি আরো বিস্তৃতভাবে করেছি। এ অনুসন্ধান স্পষ্ট করে যে, স্বাধীনতার পর গত ৪৫ বছরে দেশের অর্থনীতির বিস্তার ঘটেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়, রোজগারি কাজে যুক্ততা বেড়েছে, লেনদেনের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হয়েছে প্রায় সব দিকে। কৃষি শিল্পসহ সব ক্ষেত্রে নতুন সম্পদ যোগ হয়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু এ সম্পদ বিস্তারের ওপর অধিকার কেন্দ্রীভূত হয়েছে, বিকাশের ধরনের মধ্য থেকেই উদ্ভূত একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীর হাতে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ, দেশের অর্থনীতি বিস্তারে যারা মূল ভূমিকা পালন করেছেন, এ বর্ধিত সম্পদে তাদের অংশীদারিত্ব ক্রমে কমেছে। স্বাধীনতাকালে এ অংশীদারিত্ব ছিল জিডিপির শতকরা ৪০ ভাগ, এখন তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০ ভাগেরও কমে। চার বছর আগেও আমি এ হিসাবে পেয়েছিলাম শতকরা ২৪ ভাগ।
অর্থনীতির দৃশ্যমান সমৃদ্ধির পেছনে কৃষি শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকদের কৃতিত্বই বেশি। পাশাপাশি আছেন নির্মাণ, পরিষেবা ও অনানুষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক মানুষ। অথচ এ প্রবৃদ্ধির অংশীদারিত্বে অবস্থানের ক্রমাবনতি তাঁদের রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তির আপেক্ষিক দুর্বলতা প্রাপ্তিকেই নির্দেশ করে। বর্তমানে আইনি-বেআইনি সম্পদ যাদের হাতে কেন্দ্রীভূত, তারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত ও আগ্রাসী, রাজনৈতিক প্রশাসনিক, আইনি-বেআইনি সব ক্ষমতাই তারা চর্চা করে থাকে। আর গ্রাম শহরের শ্রমজীবী পেশাজীবী নারী পুরুষসহ বাকি সবাই আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত এবং দিশাহীন। আপেক্ষিক অবনতির কারণ সেখানেই। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন অবশ্যই হতে হবে। এর জন্য ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ এবং ‘নিরাপদে কাজের অধিকার’-এর দাবি শ্রমিকসহ সব পর্যায়ের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয়তা তৈরির অভিন্ন ক্ষেত্র হতে পারে।
সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্যই দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক. ‘সবার জন্য প্রযোজ্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এবং দুই. নিরাপদে কাজের অধিকার’। রাষ্ট্র যতই অস্বীকার বা উপেক্ষা করুক না কেন, দেশের প্রতিটি নাগরিক কাজ করে নিরাপদে বাঁচার অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এ অধিকার অনুযায়ী একটি ন্যূনতম আয়সীমা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের এবং মালিকপক্ষের। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি হচ্ছে ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ বা মাস ভিত্তিতে এ রকম মজুরি, যার নিচে দেশের কোথাও কোনো কাজে, কোনো মজুরি বা বেতন হতে পারবে না। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে এ শর্ত পূরণ করতে হবে। এবং এ মজুরি অবশ্যই বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পরিমাণ হতে হবে। সেজন্য তা কোনোভাবেই দারিদ্র্যসীমার আয়ের নিচে হতে পারবে না। (বণিব বার্তা থেকে সংগৃহীত)
লেখক : অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য সচিব, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি