
ঢাকা, ৩০ এপ্রিল, এবিনিউজ : আসছে বর্ষা মৌসুম। কয়েক বছর ধরে এ মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। আর টানা বৃষ্টি হলে এই দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। জলাবদ্ধতা দূর করতে নানা উদ্যোগ কিংবা ঘোষণা দেওয়া হলেও কোনোভাবেই এ সমস্যা দূর হচ্ছে না। রাজধানীতে জলাবদ্ধতার কারণ, অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে একটি জনপ্রিয় দৈনিকের কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলম খান। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন : প্রতি বছর বর্ষায় চরম ভোগান্তিতে পড়ে রাজধানীবাসী। ২০ থেকে ৩০ মিনিট বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় নগরের অনেক সড়ক। সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। অথচ দুই দশক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি এত প্রকট হওয়ার কারণ কী?
ড. শাহ আলম : প্রাকৃতিক কারণে বৃষ্টি হবেই। তার মধ্যে কিছু পানি অস্থায়ীভাবে জমা হবে। আর কিছু পানি সরাসরি চলে যাবে নদী, খাল কিংবা জলাশয়ে। কিছু পানি জমা থাকবে। তারপর আস্তে আস্তে সেগুলো জলাশয়ে চলে যাবে। প্রকৃতি যখন একটা জিনিস তৈরি করে তখন প্রাকৃতিক পদ্ধতিটা প্রকৃতিই তৈরি করে নেয়। ধীরে ধীরে প্রকৃতির সেই নিয়ম ভাঙা হতে লাগল। শুরু হলো নগরায়ন। তবে সেই নগরায়ন যে পরিকল্পিতভাবে হয়েছে তা নয়। যেভাবে যার সুবিধা সেভাবেই সব কিছু করা হয়েছে। নগরায়নের ক্ষেত্রে জলাশয়, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা— এগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে ধীরে ধীরে বিষয়গুলোর গুরুত্ব বেড়েছে। যেমন, ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এসে অনেক গুরুত্ব সহকারে এটাকে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আগে বিষয়টা নিয়ে এত পরিকল্পনা হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়নই জলাবদ্ধতার একটা কারণ।
আরেকটা দিক হচ্ছে অবৈধ দখলদারিত্ব। এটা আবার দুই ধরনের। একটা বেসরকারি, আরেকটা সরকারি। যেমন, আমাদের জলাশয় সংরক্ষণের নানা আইনি প্রক্রিয়া আছে। নিচু জমি, জলাভূমি ভরাট করা যাবে না—এমন প্রস্তাব সংসদেও পাশ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। নতুন কিছু প্রকল্প যেমন, পূর্বাচল, জলসিড়ি— এসব সরাসরি বন্যাকবলিত এলাকার জমি। এগুলো সবই সরকারি প্লট। কিন্তু এগুলোর বৈধ অনুমতি রয়েছে। তাহলে এটাকে কীভাবে এনক্রোচমেন্ট বলা যাবে? এটাও জলাবদ্ধতার একটা কারণ। কেননা, বৃষ্টির পানি যেখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা, যেখানে জমা হওয়ার কথা, সেসব জায়গা আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি। পানি যেখানে প্রাকৃতিকভাবে জমা হওয়ার কথা, আমাদের উচিত ছিল সেখানে একটা সমন্বয় রাখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, হয় সেখানে নগরায়ন করছি, না হয় উন্নয়নের নামে সেগুলো ব্যবহার করছি। ঢাকায় এখন যে জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে তা একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে এই ব্যাপকতা পেয়েছে।
প্রশ্ন : জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রায়ই খাল পুনরুদ্ধারের কথা বলা হয়। মাঝেমধ্যে উদ্যোগও নেওয়া হয়। খাল পুনরুদ্ধারে মূল সমস্যাটা কোথায়?
ড. শাহ আলম : এখানে টেকনিক্যাল বা আইনগত কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ম্যাজিস্ট্রেটরা যাচ্ছেন, খাল দখল হলে সেখান থেকে দখলদার উচ্ছেদ করে দিচ্ছেন, কিন্তু এটা কার্যকর থাকছে না। রাজনৈতিক কারণ এখানে বড় ব্যাপার। এটা যে শুধু ক্ষমতাসীন দলের কারণে হচ্ছে তা নয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণেও হচ্ছে। মনিটরিং হচ্ছে না, এটা নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা চলছে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে এটা কার্যকর করা যাবে না। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে খালগুলো পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : বক্স কালভার্টও রাজধানীর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। এটা কতটা সঠিক? এই সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে?
ড. শাহ আলম : হ্যাঁ, এটাও জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। কালভার্ট চারকোণা আকৃতির একটা বক্সের মতো। আর এটার সেডিমেনটেশন হার খুব বেশি। উচিত ছিল এমন কনস্ট্রাকশন করা যেটা নিচু ওয়াটার লেভেল থাকলেও পানি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। তাছাড়া আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। সব সলিড জিনিস এখানে জমা হচ্ছে। ডাবের খোসা থেকে শুরু করে ইট—এমন কিছু নেই যা কালভার্টের ভেতর পাওয়া যাবে না। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এসব বক্স কালভার্টের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভর্তি হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে পানি চলাচল করতে পারছে না। এগুলো এত লম্বা যে পরিষ্কার করার কোনো উপায় নেই। কোনো প্রযুক্তিও নাই। যে উদ্দেশে এগুলো তৈরি করা হয়েছে তা কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না। যদি ওই ধরনের প্রযুক্তি আনা যায় যেটা দিয়ে এর ভিতরটা পরিষ্কার করা যায়, তাহলে একটা উপায় হতে পারে। আরেকটা সহজ উপায় হলো এটাকে ভেঙে উন্মুক্ত করে তার ওপর এলিভেটেড রাস্তা করে দেওয়া। খোলা ড্রেনেজের সুবিধা হচ্ছে এর ভেতরে দেখা যাবে কী পরিমাণ ময়লা জমা হয়েছে, সেই সঙ্গে এটা পরিষ্কার করাও সহজ হবে।
বক্স কালভার্ট তৈরির পরিকল্পনা করার সময় ভবিষ্যৎ তো চিন্তা করা হয়ইনি; এমনকি বর্তমান পরিস্থিতির কথাও ভাবা হয়নি। যে যেখানে পারছে ময়লা স্তূপ করে রাখছে। ওয়াসার ক্লিনাররা যখন ময়লা পরিষ্কার করে তখন ওজন বেশি থাকায় তারা সেটা স্তূপ করে পাশে রাখে। কারণ ময়লার মধ্যে জমে থাকা পানিটা চলে গেলে সেটা বহন করতে তাদের সুবিধা হয়। কিন্তু তারা চিন্তা করে না এর মধ্যে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ময়লাগুলো কোথায় যাবে? এরকম আরও সিস্টেমগত কিছু সমস্যা আছে।
প্রশ্ন : বক্স কালভার্ট তৈরির ক্ষেত্রে কি কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়া হয়নি?
ড. শাহ আলম : বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাদের মতামতও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরিকল্পনাতেই ভুল ছিল। এগুলা করা হয়েছি ৮৮ সালের বন্যার পর। তখন স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়েই এগুলো করা হয়েছে। তারা ভবিষ্যৎ চিন্তা করেননি। পাম্প ড্রেনেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও তারা নিয়েছিলেন। বক্স কালভার্ট, পাম্প ড্রেনেজের মতো প্রযুক্তি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত কিনা বা এখানে কাজ করবে কিনা—সেটা চিন্তা করা হয়নি।
প্রশ্ন : রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে কোন ধরনের উদ্যোগ এখন জরুরি?
ড. শাহ আলম : ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করার কিছু প্রচেষ্টা কিন্তু হচ্ছে। অনেক খাল এরই মধ্যে পুনরুদ্ধার হয়েছে। আগারগাঁও, কল্যাণপুর—এগুলো উদ্ধারের পর কিন্তু আর দখল হয়নি। ভালো কিছু প্রজেক্টও হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হাতিরঝিল প্রজেক্টর কথা বলা যেতে পারে। ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ এলাকার পানি নিষ্কাশন করে এই হাতিরঝিল। তবে ঠিক যেভাবে করা উচিত ছিল হয়তো সেভাবে এটা হয়নি। এই প্রকল্পে বুয়েট টিমের একজন হিসেবে কাজ করেছি। প্রথমে আমরা জলাশয় এবং ড্রেনেজকে প্রাধান্য দিয়ে ডিজাইন করেছিলাম। কিন্তু পরে সেটা আর হয়নি। তার অনেক কারণও আছে। যারা ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ তারা দেখলেন ঢাকা শহরের পূর্বপশ্চিমের কোনো সংযোগ নেই। তখন তারা বললেন, এটা একটা বড় সুযোগ সড়কের সংযোগ তৈরি করার। পরে যেটা সত্যি প্রমাণিত হলো। তখন ডিজাইনে রাস্তা যোগ হলো। তখন লেক থেকে চলে গেল ৬০ ফুটের মতো জায়গা। এর পরে ল্যান্ডস্কেপ বা আরবান করিডর হিসেবে কিছু জায়গা দাবি করা হলো। সেখানেও গেল ২২ ফুটের মতো। তারপরও রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে হাতিরঝিল একটা বড় ভূমিকা রাখছে। এতো বিশাল না হলেও এরকম আরও কিছু প্রকল্প করতে পারলে রাজধানীর চিত্রই পাল্টে যেত।
প্রশ্ন : এ রকম প্রকল্প করার ক্ষেত্রে সমস্যা কী ?
ড. শাহ আলম : টেকনিক্যালি আমরা বুঝছি অনেক কিছু করা দরকার; কিন্তু রাজনৈতিক পদ্ধতিতে সেটা এসে আটকে যায়। ঢাকার ট্রাফিকও এটার বড় উদাহরণ। এখানে প্রথম প্রাধান্য হওয়ার কথা ছিল মেট্রো। কিন্তু সেটা না হয়ে ফ্লাইওভারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। একইভাবে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে প্রথমেই আমাদের প্রাধান্য চলে গেল পাম্প নিষ্কাশন পদ্ধতিতে। টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, বৃষ্টির পানি জমা হলে পাম্প করে বাইরে ফেলে দেওয়া হবে। কিন্তু পাম্প করে নিষ্কাশন করা পানি চলাচলের জন্য যে জায়গাগুলো ফ্রি থাকা দরকার ছিল সেটার চিন্তা করা হয়নি। সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে পাম্প ড্রেনেজটা এখনও আমাদের জন্য যথোপযুক্ত না।
প্রশ্ন : ড্যাপ বাস্তবায়ন ও সংশোধনীর ক্ষেত্রে সমস্যা কী?
ড. শাহ আলম : ড্যাপে মৌজা লেভেল পর্যন্ত কাজ করা হয়েছে। কোন মৌজায় কোন ধরনের উন্নয়ন হবে সেটাও প্রস্তাব করা হয়েছে। তারপরও কিছু সমস্যা আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— ধরা যাক একজন ল্যান্ড ডেভেলপারের প্রভাব, টাকা আছে। এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গেও তার যথেষ্ট জানাশোনা আছে। তিনি চাচ্ছেন একটা হাউজিং করতে। তার প্রকল্পের কিছু অংশ হয়তো বন্যাপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে গেছে। ড্যাপে এটা চিহ্নিতও আছে । তিনি তখন চাইবেন জিনিসটা পরিবর্তন হোক। দেখা যাবে তিনি রাজউকে বা ড্যাপ নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তারা তখন আবারও সেই জমির সার্ভে করাবে। প্রয়োজনে টাকা বিনিয়োগ করবে। তখন হয়তো সার্ভে রিপোর্ট দেওয়া হবে এটা বন্যাপ্রবণ বা ফ্লাড জোনের মধ্যে পড়েনি। এখানে টেকনিক্যাল সমস্যার চেয়ে রাজনৈতিক সমস্যাটাই প্রকট। পুরো বিষয়টাই একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে।
প্রশ্ন : রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
ড. শাহ আলম : বাংলাদেশে টেকনিক্যাল উন্নয়নের জন্য কোনো কিছুর অভাব নেই। বিশেষজ্ঞ কিংবা রিসোর্সেরও কোনো অভাব নেই। বাইরে থেকে পরামর্শক আনার কোনো প্রয়োজন নেই। ম্যান্ডেলার কথা, রিসোর্স কখনোই উন্নয়নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই সব ধরনের সমস্যা দূর করা সম্ভব। সব কিছুই সরকারের ওপর নির্ভর করছে। এ জন্য সবচেয়ে ভালো হয় একটা জবাবাদিহিতার ব্যবস্থা করা। (দৈনিক সমকাল থেকে সংগৃহীত)
এবিএন/সাদিক/জসিম