![‘মোগো হক সাব’ : যে যেভাবে দেখে](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/05/03/momktomot_137851.jpg)
আহমদ রফিক, ০৩ মে, এবিনিউজ : অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক (এ কে ফজলুল হক), সংক্ষেপে সবার মুখে মুখে ‘হক সাহেব’, তাঁর অঞ্চলবাসীর প্রিয় ‘মোগো হক সাব’, পরে একটি পদবি যুক্ত হয়ে তাঁর নামে ভিন্নমাত্রা যোগ করে, সেই ‘শেরেবাংলা’ কতটা তাঁর রাজনীতির সমান্তরাল ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবু নামের এ অংশটুকু যে টিকে গেছে তা-ই নয়, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলের কল্যাণে এ শব্দ দুটিই হয়ে উঠেছে হক সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের প্রতীক। বাঙালি তাঁর ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ নিয়ে গর্ব করে, এ অসাধারণ প্রজাতির নাম টেনে আনে সর্বত্র গর্ব ও গৌরবদীপ্তির প্রকাশে, তেমন ক্রিকেটে। অথচ এ প্রজাতিকে অবৈধ নির্মমতায় সংহার করে চলেছে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত বাঙালি। এদের অন্য সর্বশেষ হুমকি সম্ভবত রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র।
বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, দীর্ঘ জীবনও বলা যায় হক সাহেবের। তাঁর মৃত্যুর বছর ১৯৬২, দিনটি ২৭ এপ্রিল ভিন্ন এক দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাটি হয়তো বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই জানা নেই বা জানা থাকলেও স্মরণে নেই। এই সেক্যুলার বাঙালি রাজনীতিকের মৃত্যু ও সেই সুবাদে বিশাল শোকমিছিল—এ দুইয়ে মিলে শহর ঢাকায় একটি সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখে দিয়েছিল।
অর্থাৎ মৃত্যুর দিনটিতেও তিনি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী চেতনার প্রতীক। অবশ্য হতাশ পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি এর বদলা নিয়েছিল ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বেলে, শুরুটা আদমজী চটকলের শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র জুগিয়ে। এ দাঙ্গার বিশেষ বলি বেগম রোকেয়ার বোনের ছেলে কবি, নজরুল গবেষক আমির হোসেন চৌধুরীর শোকাবহ মৃত্যুতে।
আর ঢাকাবাসী রাজনীতিসচেতন ছাত্র-শিক্ষক ও সাংবাদিক মিলে এই প্রথম প্রবল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী অবস্থান নেন। প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বলিষ্ঠ প্রতিবাদী শিরোনাম, ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। সেই ‘রোখা’ অবশ্য অনেক সংখ্যালঘু পরিবারের প্রাণের বিনিময়ে।
আরো একটি পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে (তখনো পূর্ব পাকিস্তান নামটি আইনসিদ্ধ হয়নি, হয়েছে ১৯৫৬ সালে প্রথম সংবিধান রচনার মাধ্যমে) ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে কার্যকর করা হয় চন্দ্রঘোনা জুটমিলে এবং তার বিস্তার ঘটিয়ে, সর্বোপরি এর দায় অন্যায়ভাবে হক মন্ত্রিসভার ওপর চাপিয়ে, তাদের শাসনগত অযোগ্যতা প্রমাণ করতে।
প্রশ্নটি যোগ্যতা-অযোগ্যতার নয়, তা প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। তারা হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেতনার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বিশেষ করে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ইশতেহারের রাজনীতিকে। তাদের ভয় ছিল এই রাজনীতির প্রভাব পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানের গণতন্ত্রী মহলে, বিশেষ করে সেখানকার সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মহলে। সংখ্যায় কম হলেও তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টায় প্রেরণা জুগিয়েছিল পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব জয় ও প্রতাপশালী মুসলিম লীগের অভাবিত পতন।
শুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক ভাষিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনার দিকনির্দেশ ও আদর্শিক প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও হক মন্ত্রিসভা। ওই অল্প সময়ের মধ্যে শুদ্ধ, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চেতনার ঢেউ উঠেছিল পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মহলে। প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সালের পহেলা বৈশাখে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের একটি অসাধারণ, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী ভাষণ।
রাজনীতির ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী এই মানুষটির অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও ফজলুল হক প্রকৃত অর্থেই গ্রামবাংলার ভূমিপুত্রদের প্রতিনিধি এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি একদা প্রজাস্বার্থের পক্ষে লড়াই করে বঙ্গীয় রাজনীতির উচ্চাসনে বসতে পেরেছিলেন। যতই হোন না, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শহরবাসী একজন প্রখ্যাত আইনজীবী।
আর এ কথাও সত্য যে ব্যক্তি ফজলুল হক রাজনীতিক ফজলুল হকের তুলনায় অনেক বেশি বাঙালি, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী চেতনার বাঙালি, যদিও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মাঝেমধ্যে তাঁকে এ অবস্থান থেকে ছিটকে পড়তে সাহায্য করেছে। রাজনৈতিক স্বার্থে, মূলত ব্যক্তিস্বার্থে, কখনো কখনো বিভ্রান্তির টানে তিনি সাময়িক বিপরীত পথে হেঁটেছেন, তাতে তাঁর রাজনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন—তাঁর নিজ হাতে তৈরি কৃষক প্রজা পার্টির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জিন্নাহর মুসলিম লীগে যোগদান, মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন (১৯৪০), পরে জিন্নাহ কর্তৃক বহিষ্কৃত।
এর কারণ একাধিক, তবে মূলত একটি। তিনি চেয়েছিলেন অবিভক্ত ভারতের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একজন হতে। সেই সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক স্বার্থের রক্ষক হতে। জিন্নাহর একনায়কি নেতৃত্ব মেনে না নেওয়ার কারণে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের তৎকালীন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কোপে দল থেকে বহিষ্কৃত। অসহায় একদা শক্তিমান রাজনৈতিক নেতা ফজলুল হক, যিনি এর আগে নিজ হাতে তাঁর প্রজা পার্টি ভেঙে দিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন।
দুই.
বরিশালের শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী ফজলুল হক তাঁর রাজনীতি শুরু করেছিলেন ভূমিপুত্র তথা কৃষক প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে, প্রজাস্বত্বের যথার্থ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। শুরুতে যদিও মুসলিম লীগের রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর পথচলা, কখনো ডাইনে, কখনো মধ্যপন্থায়; কিন্তু বরাবরই প্রজাস্বার্থের পক্ষে। যেহেতু বিপুলসংখ্যক কৃষকের প্রায় সবাই মুসলমান, তাই রাজনীতিকে মুসলিম রাজনীতি বলা হলেও তা ছিল তৃণমূলভিত্তিক সেক্যুলার চরিত্রের।
ব্রুমফিল্ডের মতো একালের অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ ঘরানার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁকে ‘হিন্দু ভদ্রলোক’ শ্রেণির কাতারে টেনে ‘মুসলিম ভদ্রলোক’ রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে দাঁড় করালেও প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ বিচারে তাঁর মধ্যে ছিল দ্বৈতসত্তা, প্রতীকী বিচারে যা মাটি ও রাজপথের। একদিকে তিনি যেমন গ্রামবাংলার প্রজাস্বার্থের প্রতিনিধি, তেমনি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে পশ্চাত্পদ মুসলিম স্বার্থের রক্ষক হয়েও একজন সেক্যুলার বাঙালি রাজনীতিক।
জন ব্রুমফিল্ড দল বদলের রাজনীতির কারণে তাঁকে ‘গঙ্গাফড়িং’ নামের আপত্তিকর ও অরুচিকর শব্দে চিহ্নিত করেও লিখেছেন, ‘ফজলুল হক হিন্দু-মুসলমান সহযোগিতার প্রবক্তা।’ অন্যদিকে তাঁর মতে, তিনি কংগ্রেসি রাজনীতির ধারায় ব্রিটিশ রাজবিরোধী। হয়তো এ কারণেই শাসক শ্রেণি, বিশেষ করে বঙ্গের গভর্নররা মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক বা রাজনীতিক ফজলুল হককে বারবার ক্ষমতা থেকে হটাতে চেষ্টা করেছেন।
কংগ্রেসও যে তাঁর সঙ্গে যুক্তিসংগত ব্যবহার করেছে তা-ও নয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর হক সাহেব চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের অপরিণামদর্শী আপত্তির কারণে বাধ্য হয়ে হক সাহেবকে মুসলিম লীগের সঙ্গে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হয়, যেখানে প্রাধান্য ছিল মুসলিম লীগের। এ সূত্রেই জিন্নাহর ফাঁদে তাঁর পা বাড়ানো। এ যেন এক ‘নিয়তি নির্ধারিত ঘটনা’।
এসব কারণে তাঁর রাজনীতি প্রায় ‘নানাপথবিহারি’, যা কখনো সঠিক, প্রায়ই বেঠিক। তবু লক্ষ করার বিষয় যে তিনি যখন মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, সেই প্রাথমিক পর্বেও ফজলুল হক সম্প্রদায়বাদী রাজনীতির ধারক নন। তাই ১৯১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ফজলুল হক বলেন, ‘হিন্দু প্রকৃতিগতভাবে মুসলমানের শত্রু—হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে এমন ধারণা নিন্দনীয় ভুল।’
এদিক থেকে খাজা নাজিমুদ্দীন বা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির সঙ্গে হক রাজনীতির যথেষ্ট ফারাক, এমনকি তা ব্যক্তিগত আচরণেও। প্রকৃতপক্ষে ১৯২৯ সালে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টিই ছিল হক রাজনীতির পক্ষে সঠিক সংগঠন (অথবা জাতীয়তাবাদী মুসলিম রাজনীতি), যা অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী ও প্রজাবান্ধব রাজনীতির ধারক-বাহক। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দল বদলের কারণে সঠিক ধারার এই সংগঠন সমৃদ্ধ হতে পারেনি। বরং ক্রমেই দুর্বল হয়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে।
ক্ষণিক মোহে ফজলুল হক ভুলে গিয়েছিলেন যে তৃণমূল স্তরের ভূমিপুত্ররাই তাঁর রাজনীতির মূলশক্তি। এর প্রমাণ মেলে নির্বাচনে শহুরে আসনের তুলনায় গ্রামগঞ্জের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে তাঁর জয় এবং সেখানে তাঁর বিপুল ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৯৪৫-৪৬ সালে যখন তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর স্বকৃত ভুলে শক্তিহীন অসহায় নায়ক তখনো ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের জোয়ারি প্রভাবের মধ্যেও হক সাহেব লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে দু-দুটি আসনে জয়ী। বলতে হয় অবিশ্বাস্য ঘটনা।
তিন.
ফজলুল হক রাজনৈতিক বিচারে তাঁর মধ্যবিত্ত শ্রেণিসত্তার ঊর্ধ্বে প্রকৃতপক্ষে একজন তৃণমূল স্তরের শ্রেণিস্বার্থের নেতা হয়েও মাঝেমধ্যে আদর্শগত বিচ্যুতির কারণে বঙ্গীয় রাজনীতিতে প্রত্যাশিত ইতিহাস গড়তে পারেননি। অথচ সে শক্তি তাঁর ছিল, সম্ভাবনাও ছিল তাঁর পক্ষে। কিন্তু এ পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। অন্যদিকে কংগ্রেস ও লীগের কর্তৃত্বপরায়ণ কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও শাসকদের দ্বিমুখী রাজনীতি হক সাহেবের জন্য প্রতিকূল আবহ তৈরি করেছিল।
রাজনৈতিক পরিবেশ মূলত শাসকদের এবং সেই সঙ্গে লীগ-কংগ্রেসের রাজনৈতিক আচরণের কারণে সেক্যুলার গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল না। মুসলিম স্বার্থরক্ষার প্রবক্তা হয়েও ফজলুল হক ছিলেন শাসক প্রবর্তিত স্বতন্ত্র নির্বাচনের বিরোধী। কিন্তু পরিস্থিতি যেন অমোঘ নিয়তির টানে সুস্থ রাজনীতিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ ও রক্তস্নাত দিনগুলোতে যখন লীগ বনাম কংগ্রেস তথা হিন্দু-মুসলমান অমানবিক সংঘাতে মত্ত তখন ফজলুল হক ঘটনার অসহায়, নীরব দর্শক। প্রতিরোধের কোনো হাতিয়ার তাঁর হাতে নেই।
তবু ফজলুল হক রাজনৈতিক বিচারে সত্যই এক বিস্ময়। অসাধারণ সম্ভাবনা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি একজন ব্যর্থ নায়ক। অর্জুনের মতো, এমনকি জিন্নাহর মতো একমুখী আদর্শিক লক্ষ্য তাঁর ছিল না, যা ব্যর্থতার কারণ। বিস্ময়কর যে, যে মুসলিম লীগকে, বিশেষত যে জিন্নাহকে তিনি মনে-প্রাণে অপছন্দ করতেন (কামরুদ্দীন আহমদ দ্রষ্টব্য), দেশভাগের পর সেই শাসক মুসলিম লীগের রাজত্বে তাদের অধীনে তিনি পূর্ববঙ্গ সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ গ্রহণ করেছিলেন। অথচ তিনি একজন সফল আইনজীবী, অর্থাভাবও তাঁর খুব একটা ছিল না। তবু কেন এ আপসবাদ-সুবিধাবাদ?
এ বৈশিষ্ট্যই ছিল ফজলুল হক চরিত্রের ও তাঁর রাজনীতির বড় দুর্বলতা। একই কারণে অর্থাৎ ক্ষমতার জন্য তিনি ১৯৫৫ সালের পর যুক্তফ্রন্ট ভাঙার অন্যতম প্রধান কারিগর। এমনকি পরে মুসলিম লীগ শাসিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়া তাঁর জন্য ছিল আত্মঘাতী পদক্ষেপ। তবু কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র ও আওয়ামী লীগ বিরোধিতার টানে তিনি পথচ্যুত।
তবু বঙ্গীয় রাজনীতির দুই পর্বেই ফজলুল হক একজন অসাধারণ ক্যারিসমেটিক নেতা। রাজনীতির দুটি কাল পর্বের তিনি বাহক। অসাধারণ বাগ্মী, সুরসিক বক্তা, জনমত আকর্ষণে প্রবল শক্তিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফজলুল হক ছিলেন একই রকম ভোজনবিলাসী। আর প্রতিপক্ষকে তর্কে-যুক্তিতে, কখনো কথার চাতুর্য ও কুশলতায় হারাতে পারঙ্গম এই রাজনীতিক তাঁর প্রতিভার সদ্ব্যবহার করেননি।
মেধাবী ও মননশীল হওয়া সত্ত্বেও ফজলুল হক জাগতিক বিষয়ে এতটা আকৃষ্ট ছিলেন যে একটি বর্ণাঢ্য ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনযাপন সত্ত্বেও একটি আত্মজীবনী রচনায় আগ্রহী হলেন না। শেষ পর্যায়ে যখন আগ্রহী হলেন তখন পরিবেশ-পরিস্থিতি খুব একটা তাঁর অনুকূলে নয়। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গীয় রাজনীতি, বিশেষ করে মুসলিম রাজনীতির সংঘাতময় বিশাল অধ্যায়ের অনেক কিছু অনুদ্ঘাটিত থেকে গেল। এখানেই গান্ধী, নেহরু, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখের সঙ্গে হক বা জিন্নাহর নান্দনিক প্রভেদ। তাঁর মৃত্যু একটি বিশেষ রাজনৈতিক যুগের অবসান ঘটিয়েছে। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী