![প্রধানমন্ত্রীর সিডনি সফরনামা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/05/04/ajoy-das_138010.jpg)
অজয় দাশগুপ্ত, ০৪ মে, এবিনিউজ : গণতন্ত্রের সুফল ও কু ফল আছে বৈকি। সুফল আমরা দেখছি পাশ্চাত্যে। আর কুফল? ভারতেই দেখুন। মানুষ চায় বলে বিজেপি আজ সরকারে। সেই সরকার ভারতের এতদিনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকে ব্যাহত করলেও মানতে হচ্ছে। নেহেরু কিংবা গান্ধীর ভারত আর আজকের ভারতে অনেক তফাৎ। তারপরও মোদীর প্রিয়তা নিয়ে কথা চলে না। এই পরিবর্তন সেখানকার ভবিষ্যৎ বা ভারতের রাজনীতিকে যেখানেই নিয়ে যাক আর্থিক ও বৈষয়িক উন্নয়নে ভারত এগিয়ে চলেছে। চলেছে বলেই মানুষ সরকারের ধার ধারে না। কারণ পুঁজিবাদের যেটা নিশানা সেটাই এখন সার্থক। আদর্শ বা বোধ জাতীয় বিষয়গুলো থাকলে থাকলো না থাকলে নেই। মানুষ আহার নিদ্রা মৈথুনে খুশি হলেই হলো। বলাবাহুল্য আজকের বাংলাদেশও সে পথে অনেকটাই এগিয়ে আছে। কিন্তু ভারতের ধর্ম বিষয়ক রাজনীতি আর আমাদের ধর্মের রাজনীতির একটাই তফাৎ। আমাদের দেশে এই ধারাকে বেগবান করছে জাতীয়তাবাদী নামের শক্তি। যার কাছে দেশপ্রেম তুচ্ছ। ইতিহাস থাকলে আছে না থাকলে নাই। বিকৃতি আর গাঁজাখুরি গল্পে একটা কিছু হলেই হলো। সবার আগে চাই সরকারি পদ বা গদী। সেই কারণে দেশের মত বিদেশেও উগ্রতা হিংসা এবং ভেদাভেদ এখন চরম পর্যায়ে। যার একটা নমুনা দেখা গেলো বিলেতে।
শেখ হাসিনা এখন বিদেশে গেলেই যথাযোগ্য সম্মান ও পদকে ভূষিত হন। সেই উচ্চতা তাঁর অর্জন। এর মানে এই না তিনি যা করছেন তার সবটাই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এটাও মানতে হবে তাঁর কোন বিকল্প নেই। অন্তত এখন আমাদের শেষ ভরসা তিনি। ভারত বা পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইতিহাস বিষয়ক তর্ক নাই। তাঁরা গান্ধী জিন্নাহ বা দেশজ ইতিহাসকে অপমান করে না। বিদেশে তো করেই না। বরং মোদীর মত সাম্প্রদায়িক দলের নেতাও গান্ধীর মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হন। আমাদের দিকটা দেখুন। এবার ইংল্যান্ডে মানে লন্ডনে শেখ হাসিনার সফর কালে বিএনপির একদল কর্মী নেতারা চোখ কান খুইয়ে লজ্জা শরম ছেড়ে এমন োগান দিলেন যাতে মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক। ব্যক্তি জীবনে আমি সংশয়বাদী মানুষ। নিজের বিপদ আপদ ছাড়া ঈশ্বরের শরণাগত হবার কারণ পাই না। কারণ দেখি না ঈশ্বর বিষয়ক তর্কে ডুবে থাকার। কিন্তু কারো অনুভূতি বা ধর্মীয় বোথে আঘাত হানা আমার মতে অনুচিত। বিশেষত তার কারণ যদি হয় রাজনীতি।
বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির জনক। যদি আপনি তা মানতে নাও চান আপনাকে রাষ্ট্রকাঠামোর অনেক বিষয়ের মত এ নিয়েও শালীন এবং সভ্য আচরণ করতে হবে। সেটা মাথায় না রেখে তারা লন্ডনের রাস্তায় হিন্দু অবতার বা দেব দেবীদের নামে এমন সব োগান দিয়েছেন যাতে আঘাত লাগাটাই স্বাভাবিক। এদের কথায় কিছু আসে যায় না বলে যারা নিশ্চিন্তে ঘুমায় তারাও তলে তলে এগুলো চায়। কারণ এতে সহজ সাধারণ বাঙালি মুসলমানের মনে একটা খটকাতো লাগানো যায়। সেটা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যবহার করার পরও তারা সে অস্ত্রের কাছে নতজানু। একদা এগুলো বলে ফায়দা হতো। ভোট বাড়তো। এখন হয় কি হয় না জানি না, তবে এর প্রভাব বা অপ ইচ্ছা এখন বিলেতের মত জায়গায় ও তার বিকৃত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
তাঁর আগমন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগারদের ভেতর যত রাজনীতি তার ছিটেফোঁটাও নেই গঠনমূলক প্রচারণায়। ভাবখানা এই তিনি আসবেন তারা পালা করে স্টেজে যাবেন নিজেদের সুরত দেখাবেন ব্যস তাতেই কাজ শেষ। আমরা একথা বলার অধিকার রাখি না কে স্টেজে যাবে আর কে যাবেন না। যারা দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে লীগের রাজনীতি করেন তারা কথা বলবেন এটা তাদের হক। কিন্তু যে আভাস ইঙ্গিত বা নমুনা দেখছি তাতে এটা নিশ্চিত নেত্রী ফিরে যাবার পর এখানকার আওয়ামী শক্তি দুর্বল হবেই। যার মূল কারণ তারুণ্য ও আওয়ামী লীগের প্রতি দুর্বল বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি এদের অনীহা। এখানে একটা মুশকিল এই, আমরা বললেই ধরে নেয় আমরা মঞ্চে যেতে চাই। এদের পোষ্য কিছু লেখক বা মুখ দেখানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত নপুংসকরা ফেইসবুক বা সামাজিক মিডিয়ায় অসম্পাদিত দেয়ালে আমাদের যা খুশি গালাগাল করে ঝাল মেটায়। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কি? যেখানে বাড়ি বাড়ি দাওয়াতের নামে ধর্মের রাজনীতি সচল যেখানে ঘরে ঘরে ধর্মের নামে বিভেদ বিভাজনের কারখানা সেখানে কি প্রগতির রাজনীতি নামে আওয়ামী লীগের কয়েকটি কমিটি বানানো? আর নেত্রী বা তেমন কেউ এলে তাদের সত্য জানতে না দেয়া? সবাই জানেন বাংলাদেশের অন্য যে কোন নেতারা এখন দুধ ভাত। তাদের কাছে কিছু বলা মানে অরণ্যে রোদন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যাই কথা শোনেন আর তাঁর নির্দেশেই কাজ হয়। সেখানে নিজেদের কলহ জাবেজ করার নামে নিজেরা পিঠা ভাগ করে খেয়ে বাকিদের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য ডেকে নেয়ার কি আদৌ কোন অর্থ আছে? প্রশ্ন উঠতে পারে সভা যখন আওয়ামী লীগের তারাইতো ঠিক করবেন কে কি করবে। একদম ঠিক কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি শুধুই আওয়ামী লীগের? না দেশের? তিনি একাধারে নেত্রী আবার সরকার প্রধান। তার ওপরে আমাদের জাতির জনকের কন্যা। সবার চেয়ে বড় তাঁর প্রতি আমাদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসটুকুতে তারুণ্যকে যদি মর্যাদা দেয়া না হয় কে সামলাবে প্রবাসী দুর্গ?
যারা বলেন দেশের রাজনীতির বিদেশে দরকার নেই আমি এখনো তাদের সাথে একমত হতে পারি না। কারণ দরকার না থাকলে সেটা সবার জন্য দরকার নাই হতে হবে। তলে তলে বিএনপি জামাতের রাজনীতি চললে শুধু আওয়ামী লীগ বা বাম কিংবা প্রগতির রাজনীতি বন্ধ হবে কোন সুখে? কে না জানে বিএনপির আগামী দিনের নেতা তারেক রহমান থাকেন বিলেতে। আছে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনার নেতারাও। ফলে একথা বলা যাবেনা বিদেশে দেশের রাজনীতি টোট্যালই বন্ধ করা উচিত। বরং এর একটা সহনীয় মাত্রা আর সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। যারা নেত্রীকে ঘিরে থাকবেন তারা তাঁকে তা জানাবেন না। এটাই আমাদের বড় সমস্যা। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৯ সালে যখন সিডনি এসেছিলেন তখন এত রাজনীতি আর দলভেদ দেখিনি। এখন এটা এমন পর্যায়ে এতে মাথা গলাতেও ভয় হয়। অথচ তখন যেসব তরুণেরা সাহসে ভর করে তাঁকে নালিশ জানিয়েছিল বা জানাতে পেরেছিল তিনি তা শুনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেও দেরি করেননি। এখন দেশের মত এখানেও রাখ রাখ ঢাক ঢাক চলছে। কোনক্রমে তাঁকে সব ঠিক বলে বিদায় দিয়ে নিজেরা ফটো আপলোড করতে পারলেই হবে।
খুব আশ্চর্য না হলেও অবাক হচ্ছি কাল পর্যন্ত যারা একে অপরকে পটানোর জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে ছিলেন কুৎসা রটিয়ে বা ঘটনা ফাঁস করার নামে তারুণ্যকে নিয়ে খেলেছেন তারাই আজ আপোসের জালে। এই আপোস শুধুমাত্র নেত্রীর সাথে বসার বা তাঁকে দেখানোর প্রতিযোগিতা। আগেই লিখেছি আমাদের পচন আদর্শহীনতা এবং চারিত্র আমরা দেশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে নিয়ে আসি। এবং সময় ও সুযোগ মত তার ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিতে চাই, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। অথচ বঙ্গবন্ধু বড় আশা নিয়ে বলেছিলেন দেখে যাও কবিগুরু তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সিডনি সফর সফলভাবে শেষ হয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতির পদক নিয়ে মানুষের ভালোবাসা ও এদেশের সরকারের সমর্থন সাথে নিয়ে তিনি নিরাপদে দেশে ফিরে গিয়েছেন। চলে যাওয়া ও আসার উত্তেজনা আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসছে। যে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিলো আমাদের তার অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে। যে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের বর্ণনা তিনি দিয়ে গেছেন তাতে এটা স্পষ্ট আগামীবার তাঁর কোন বিকল্প নাই। বাংলাদেশ আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তার শরীরে যে আবহ যে পরিবর্তন তাকে সামনে নিতে হলে আগামীবারে তাঁর নেতৃত্বের বিকল্প দেখি না। বিস্মিত হয়ে দেখলাম কি চমৎকার স্মৃতিশক্তি তাঁর। কোথায় কোন গ্রামের সাধারণ মহিলা বিদ্যুৎ সংযোগের পর তাঁকে অবাক করে দিয়ে জানিয়েছিল তারা এখন রাইসকুকারে রান্না করেন সেটাও মনে রেখেছেন তিনি। এবং আমাদের বলতে ভুলেননি এতটা অগ্রসরতা তাঁর কাছেও ছিলো চমকপ্রদ। এবং তিনি এখন এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে আরো চেষ্টা আরো কাজ করবে। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী যেসব তথ্য উপাত্ত আর পরিসংখ্যান মুখস্থ বলে দিলেন আমি নিশ্চিত আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী এবং নেতারা তা পারবেন না। তাদের কাজ নিয়মিত দলবাজী আর স্তাবকতা। সর্বদায় সব কাজের ভার সব আপদ বিপদ তারা মহানন্দে একা শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে মহানন্দে নিজেদের সুখ শান্তি উপভোগ করে চলেছেন।
বিদেশেও তাই। প্রধানমন্ত্রীর নাগরিক সংবর্ধনার নামে তিন চার ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগের নেতারা সে সন্ধ্যার জন্য সবাই এক সাথে স্টেজে উঠে তাঁকে চেহারা দেখালেও বিবাদ ছাড়েনি। যে কারণে পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়ে তিরস্কৃতও হয়েছে তারা। জনশ্রুতি যে একজনকে তিনি থামতে ধমক দিয়েছিলেন আর একজনকে তার স্তাবকতার পরও বলেছেন, আপনি ও দোকান খুলে বসেছেন এখানে? আর একজনকে তো সভাতেই বলে দিয়েছেন তিনি তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেন। তারপরও এরা থেমে নাই। দেখে শুনে মনে হয় তারা ভেবেছেন এটাই দোয়া এটাই আশীর্বাদ। সাধারণ প্রবাসীরা এখন সত্যি দ্বন্দ্বে তাদের একটাই ভাবনা কি হবে আগামী নির্বাচনে?
কে না জানে ভেতরে ভেতরে বিএনপি কতটা শক্তিশালী। তাদের জনপ্রিয়তা অবজ্ঞা বা ছোট করে দেখা মানে নিজেকে পরাজিত করা। সাথে আছে জামাতের প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতি। বিএনপি ও ছেড়ে কথা বলবে না। এইসব সমীকরণের পরও এরা আছে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। সবাই ভাবছে নেত্রীকে যখন চেহারা দেখানো গেছে এবার আর আমাদের পায় কে?
অস্বীকার করি না এদের অনেকের অবদান আছে। বিদেশে দেশের রাজনীতি কতটা দরকার সে তর্ক থাকার পরও এরা দুঃসময়ে দল ও দেশের পাশে দাঁড়ায়। শক্তি যোগায়। এবারও প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে বিএনপির কুৎসিত প্রতিবাদের জবাব দিয়েছে তারুণ্য। এরাই ভরসা। আর যারা নেতা হবার জন্য নিজের ভাগ্য ও দলবাজির জন্য এসব করেন তারা সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় সেসব কাউয়া যাদের কা কা রবে বিদেশের বাঙালি আজ অসহায়। অথচ ময়ূর না হলে তাদের কেউ ভালোবাসবে?
কাউয়াকেতো মানুষ আঙিনা থেকেই খেদিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী আর কবে সত্য জানবেন আর কবে দল আসলে সকলের হয়ে উঠবে কে জানে? তবু তিনিই আমাদের শেষ ভরসা। সামনাসামনি বসে তাঁকে দেখা ও কথা শোনার অভিজ্ঞতায় আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
(সংগৃহীত)